মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ সাগর পথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার তৎপরতার বড় একটি ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। প্রায় দুইমাস সময় সাগর রুট থেকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না পেরে ৩৯৬ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূলে পৌঁছার পর তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে এদের হস্তান্তর করা হয়েছে ইউএনএইচসিআরকে। বুধবার রাত ৯টার পর এ ঘটনা ঘটেছে টেকনাফের বাহারছড়ায়। কোস্টগার্ড জানিয়েছে, এসব রোহিঙ্গা বহনকারী মিয়ানমারের একটি ট্রলার আটক করা হয়েছে। অপরদিকে, দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ার লংকাউই দ্বীপের অদূরে প্রায় ৭শ’ রোহিঙ্গা বোঝাই অপর দুটি ট্রলার ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। মালয়েশিয়া কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে তাদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গ্রহণ করা হচ্ছে না। মালয়েশিয়ার সাগর সীমানা থেকে এসব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি মূলত পুশব্যাক। এখনও অপেক্ষমাণ অপর দুটি রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারকেও পুশব্যাক করার সম্ভাবনা রয়েছে। কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাগর সীমানা রক্ষায় নিয়োজিত নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সূত্রে জানানো হয়েছে, মূলত এ ঘটনা মানবপাচারের একটি অংশ। প্রতি বছর এ মৌসুমে টেকনাফ সেন্টমার্টিন দিয়ে সাগর পথে মানবপাচারের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ঘটনা রোধে সরকার কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করার পর কিছুটা কমে আসলেও মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত মাফিয়া চক্রের সদস্যরা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বৃহস্পতিবার টেকনাফ কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বুধবার ৯টার পর টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে মেরিন ড্রাইভের পশ্চিম পাশের জাহাজপুরা ঘাট এলাকা থেকে ৩৯৬ রোহিঙ্গা বোঝাই একটি ট্রলার আটক করা হয়। এদের মধ্যে পুরুষ ১৫০, মহিলা ১৮২ ও শিশু রয়েছে ৬৪। কোস্টগার্ড জানিয়েছে, বাহারছড়া জাহাজপুর ঘাটের অদূরে একটি ফিশিং ট্রলার ভাসমান অবস্থায় রয়েছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ট্রলারটিকে আটক করা হয়। আটকের পর এ ট্রলার থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। এরপর পুলিশ ও বিজিবির সহায়তায় উদ্ধারকৃতদের তাৎক্ষণিক খাবার, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এসব সদস্যের কিছু অংশ বাংলাদেশে আশ্রিতদের মধ্যে রয়েছে। আর কিছু রয়েছে সীমান্ত এলাকার ওপার থেকে যাওয়া। সূত্র জানায়, মূলত ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে এরা গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারে উঠে। উদ্দেশ্য মালয়েশিয়ায় গমন। এ ঘটনা এরই একটি অংশ। এর আগে আরও প্রায় সাত শ’ রোহিঙ্গা নিয়ে দুটি ফিশিং ট্রলার মালয়েশিয়া উপকূলে পৌঁছেছে, যেগুলো সে দেশের লংকাউই দ্বীপের অদূরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। মালয়েশিয়ান কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা জোগান দেয়া হচ্ছে। তবে এ দুটি রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে এদেরও সে দেশের সাগর সীমানা থেকে বের করে দেয়া হবে। এরপর তাদের গন্তব্য কি হবে তা এখনও অজানা। কক্সবাজারের প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে ৩৯৬ রোহিঙ্গা বোঝাই এ ট্রলারটি সে দেশে প্রবেশ করতে পারেনি। কোস্টগার্ডের টেকনাফ জোনের কর্মকর্তা লে. কমান্ডার এম সোহেল রানা জানান, রোহিঙ্গা ভর্তি এ ফিশিং ট্রলারটি জাহাজপুরা ঘাট এলাকা থেকে আটক করা হয়। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, এসব রোহিঙ্গার সকলেই বাংলাদেশে আশ্রিত নয়। কিছু অংশ আছে আশ্রয় ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গেছে। আর কিছু অংশ এসেছে সীমান্তের ওপার থেকে। মূলত গভীর সমুদ্রে অপেক্ষমাণ ফিশিং ট্রলারে এরা একজোট হয়। টেকনাফের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় আশ্রিত ও নতুন অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সরকারের নিষেধ থাকায় রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। তবে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে দুএকজন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, নতুন করে রোহিঙ্গা আগমনে নিবন্ধন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর। মেডিক্যাল স্ক্রিনিং, আইসোলেশন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেচলা সংক্রান্ত ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে ৪৬ নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে বলেও জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, নতুন করে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা এ পারে চলে আসলে তাদের নিবন্ধের আওতায় আনার সুবিধার কারণে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে। সূত্র জানিয়েছে, উখিয়া টেকনাফে আশ্রিতদের সরকারী নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন করে আসা ৪৬ রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। ইউএনএইচসিআরের একটি সূত্র জানিয়েছে, নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গার মাঝে করোনাভাইরাস থাকলে তা ক্যাম্পজুড়ে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় উদ্ধারকৃতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে পুরো কক্সবাজারকে লকডাউনের আওতায় রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো এ পর্যটন নগরীতেও সব ধরনের প্রতিষ্ঠান যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ৩৪টি ক্যাম্পও রয়েছে। এ অবস্থায় আশ্রয় ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ কিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়া গমনের জন্য তৎপরতা চালিয়েছে তা একটি বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ওপারের একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টায় ছিল। বিজিবির কঠোর নজরদারিতে তা ঘটতে পারেনি। এদেরই একটি অংশ মানবপাচারকারীদের গোপন তৎপতায় ছোট ইঞ্জিনবোটযোগে গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ ফিশিং ট্রলারে উঠে। বিষয়টির শতভাগ সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন। কোস্টগার্ড বলেছে, কোয়ারেন্টাইন শেষে উদ্ধারকৃতদের বক্তব্য গ্রহণ করা হবে এবং তখন কারা এপার থেকে কারা ওপার থেকে ফিশিং ট্রলারে উঠেছে তা বেরিয়ে আসবে।
টেকনাফ সাগরে অজ্ঞাত লাশ ॥ টেকনাফের বাহারছড়া সমুদ্র তীরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, লাশটি টেকনাফের জাহাজপুরা ঘাটে বোট বোঝাই রোহিঙ্গারা হুড়াহুড়ি করে অনুপ্রবেশ করার সময় বোট থেকে ঝড়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় সমুদ্র কূলে লাশটি ভেসে এসেছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ ইনচার্জ লিয়াকত আলী বলেন, লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তবে এখনও পরিচয় পাওয়া যায়নি।