ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাতা থেকে জমানো অর্থ সন্তানের হাতে তুলে দিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ১০:০১, ৬ এপ্রিল ২০২০

ভাতা থেকে জমানো অর্থ  সন্তানের হাতে তুলে  দিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা

মোরসালিন মিজান ॥ মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণ বোকা। অন্তত আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে তৃণমূলের বীর যোদ্ধাদের যে কেউ বোকা জ্ঞান করবেন। সেইসব বোকা মানুষদের, হয়তো এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না, তবুও বলি, সেইসব বোকা মানুষদেরই একজন জীবন মিয়া সরকার। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্র তাঁকে যে সম্মানী ভাতা প্রদান করে, সেখান থেকে জমানো অর্থ নিজের সন্তানের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। না, ব্যক্তিগত খরচের জন্য নয়। বরং করোনায় সঙ্কটে পড়া হতদরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা দিতে ১ লাখ টাকা ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের যে কমিটমেন্ট, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে যেন আরও একবার প্রমাণ হলো। বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সে আহ্বানে ২০২০ সালে এসেও সাড়া দিলেন জীবন মিয়া সরকার। কারসাজি করে দ্রব্যমূল বাড়ানো, বেশি বেশি পণ্য কিনে ঘরে মওজুদ করার বিপরীতে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি। জানা যায়, জীবন মিয়া সরকার ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে প্রথম ডাকেই যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন তিনি। দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে দু’বার ভাবেননি। জীবন বাজি রেখে দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করা বীর, বলার অপেক্ষা রাখে না, যোগ্য সম্মান পাননি। কিন্তু এখনও তাঁর ভাবনাজুড়ে দেশ। দেশের মানুষ। বিশেষ করে বর্তমানে করোনাভাইরাসের আঘাতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। হুমকির মুখে আছে বাংলাদেশও। অন্যরা লম্বা ছুটিতে ঘরে বসে কাটাচ্ছেন বটে, বিপদে পড়েছেন দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের পাশে দাঁড়ানোকেই এই সময়ের দায়িত্ব মনে করেছেন মুক্তিযোদ্ধা জীবন মিয়া সরকার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি টঙ্গীর বাসিন্দা। বয়স এখন প্রায় ৮০ বছর। ৮ সন্তানের জনক তিনি। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। যে যার দায়িত্বও বুঝে নিয়েছে। তাই বলে জীবন মিয়া সরকার বসে নেই। এরশাদনগর বড় বাজারে একটি মুদি দোকান পরিচালনা করেন তিনি। এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া রাষ্ট্রীয় ভাতায় তাঁর মোটামুটি চলে যায়। তবে গত দশ মাসের ভাতা খরচ করেননি তিনি। জমিয়ে রাখা অর্থ স্ত্রীর উপস্থিতিতে ছেলে আক্তার সরকারের হাতে তুলে দেন। সন্তানটিও বাবার মানবিক চরিত্র নিজেদের মধ্যে ধারণের চেষ্টা করছেন। এ কারণেই হয়ত গত ২৬ মার্চ থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে দেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছেলে নিজের টাকায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। এ পর্যায়ে এসে পিতার সহায়তা চান তিনি। ছেলের কাজে সন্তুষ্ট বাবা মুহূর্তেই রাজি হয়ে যান। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে রবিবার মোবাইল ফোনে জনকণ্ঠকে আক্তার বলেন, গত বৃহস্পতিবার বাবা আমাকে বাসায় ডেকে নিয়ে যান। জানতে চান, কোন কোন এলাকায় এবং কাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছি? আমি বিস্তারিত জানালে তিনি বাদ পড়া কয়েকটি এলাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁর নিজের দোকান ও আশপাশের এলাকার দরিদ্র মানুষের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করতে বলেন। কথা বলার এ পর্যায়ে নিজের জমিয়ে রাখা নগদ টাকার একটি বান্ডিল আমার দিকে বাড়িয়ে দেন। বলেন, এখানে ১ লাখ টাকা আছে। আমার দশমাসের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। এই টাকা দিয়ে ৫০ বস্তা চাল কিনে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করবি। কথা শুনে আমি চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি। বাবার চোখও ভিজে যায়। মা পাশে ছিলেন। তিনিও কেঁদে ফেলেন। পরে আমি বাবা মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে টাকা নিয়ে চলে আসি। আক্তার জানান, বাবার দেয়া অর্থে চাল কিনেছেন তিনি। সে চাল গত শনি ও রবিবার দরিদ্র দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ সময় তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা নিজে উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা জীবন মিয়া সরকারের সঙ্গেও। মানবিক মানুষটি ফোনে জনকণ্ঠকে বলেন, আমি আমার ছেলে মেয়েদের কাছে হাতটাত পাতি না। দোকান তো আছেই। সেইসঙ্গে সরকারী ভাতাটা পাওয়ায় চলে যায়। তাই করোনার সময় গরিব মানুষ কষ্ট করছে দেখে জমানো টাকা ত্রাণের জন্য দিয়ে দিয়েছি। আমার ছেলেও ওদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছিল। ওর খুশির কথা ভেবেও দিয়ে দিলাম। ’৮৮’র বন্যার সময়ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে ছিলেন বলে জানান তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার বড় ভাইও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু খুব ছোট ছিলাম। শরীরের ওজনও বেশি ছিল। তাই ভাই আমাকে প্রথমে নিতে চায়নি। আমি তবু তাদের পেছনে পেছনে যাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। পরে তারা আমাকে সঙ্গে নেয়। এখন এপ্রিল মাস। এই এপ্রিলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। পরে ভারতে গেরিলা ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন বলে জানান তিনি। বলেন, দেশের জন্য মানুষের জন্যই তো যুদ্ধে গিয়েছিলাম। দেশ ভাল থাকলে, মানুষ ভাল থাকলেই আনন্দ। একই কারণে আজকের সঙ্কটের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে জানান তিনি। পরের কথাটি না উল্লেখ করলেই নয়। জীবন মিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জমানো টাকা দান করে দিলেন। আপনার স্ত্রীর তাতে সায় ছিল? জবাবে সহজ সরল মুক্তিযোদ্ধাটি বলেন, আমার স্ত্রী আরও সহজ। তারও তো আনন্দ! এই আনন্দ উপভোগ করতে শিখুক বাংলাদেশ। আজকের দিনে এর চেয়ে বড় আনন্দ আসলেই কিছু হয় না।
×