ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মালয়েশিয়ায় পাচারকালে সাগরে ইঞ্জিনবোটডুবি ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু

প্রকাশিত: ১১:১১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

মালয়েশিয়ায় পাচারকালে সাগরে ইঞ্জিনবোটডুবি ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সাগরপথে মানবপাচারের অবৈধ তৎপরতার অংশ হিসেবে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন সংলগ্ন ছেঁড়াদ্বীপের কাছে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গা বোঝাই একটি ইঞ্জিনবোট ডুবে গেছে। এ ঘটনার পর নৌবাহিনীর সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী ১৫ নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। জীবিত উদ্ধার হয়েছে ৭৫ জন। এরা সবাই রোহিঙ্গা। মৃতদের মধ্যে ১২ নারী ও তিন শিশু রয়েছে। জীবিত উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে ২৪ পুরুষ, ৪৬ নারী ও তিন শিশু রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার ভোরের আগে টেকনাফের বাহারছড়া থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি বোটে করে গভীর সাগরে নিয়ে উঠানো হয় দুটি ইঞ্জিনবোটে। এর মধ্যে একটি ডুবে যায়। অপরটিতে থাকা রোহিঙ্গারা অক্ষত রয়েছে। ওই ইঞ্জিনবোটে নারী-পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ১০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। উদ্ধারকৃতদের টেকনাফ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদের মধ্যে মানবপাচারকারী দলের চার সদস্যকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেন্টমার্টিনের অদূরে টহলরত নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজ অকুস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। প্রশাসন সূত্র জানায়, এখনও দশজন নিখোঁজ রয়েছে। নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস দুর্জয়, বিএনএস করতোয়া ও কোস্টগার্ডের জাহাজ মনসুর আলী উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। উদ্ধার কাজে নৌবাহিনীর ডুবুরি, বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার নিয়োগ করা হয়েছে। কোস্টগার্ডের প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী টিমও উদ্ধার কাজে রয়েছে। সন্ধ্যার পর উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়। বুধবার সকাল থেকে পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু করা হবে বলে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সূত্রে জানানো হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্র খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ভোরের আগে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু গভীর সাগরে অবস্থানরত ইঞ্জিনচালিত দুটি বোটে উঠে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে। বোট দুটি ভোরের পর অর্থাৎ সকালের দিকে টেকনাফ অতিক্রম করে সন্নিহিত ছেঁড়াদ্বীপের কাছে পৌঁছায়। এর মধ্যে একটি বোটের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। বোটটি ভাসতে ভাসতে ছেঁড়াদ্বীপের কাছে পৌঁছার আগে সকাল সাতটার দিকে সাগরের তলদেশে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। এ সময় অদূরে টহলরত নৌবাহিনীর জাহাজ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। শুরুতে তারা ভাসমান অবস্থায় থাকা ৪০ জনকে উদ্ধার করে জাহাজে তুলে নেয়। এরপর ১০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে আরও পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী, আরও ৪৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ বিষয়টি আলোচনার পর কোস্টগার্ডের তথ্যমতে, ডুবে যাওয়া ওই ইঞ্জিনবোটে ১২৫ রোহিঙ্গা ছিল। উদ্ধার হওয়া জীবিত রোহিঙ্গাদের সবাইকে সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে নিয়ে আসা হয়েছে। সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী একটি ইঞ্জিনবোট ডুবির ঘটনায় স্থানীয়রা বিস্মিত। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, ইঞ্জিনবোট ডুবির খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারসহ যাবতীয় তৎপরতা গ্রহণ করা হয়। তিনি নিশ্চিত করেছেন, সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার অবৈধ তৎপরতার এ ঘটনায় সবাই ছিল রোহিঙ্গা। এদিকে প্রশাসনসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, টেকনাফ থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই ওই দুটি ইঞ্জিনবোট ছাড়ার তথ্য থাকলেও একটি ডুবেছে অন্যটিতে থাকা রোহিঙ্গারা অক্ষত আছে। ইঞ্জিনবোটটি ডুবে যাওয়ার পর উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানায়, দালালদের মাধ্যমে আশ্রয় শিবির থেকে অতি গোপনে তারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। উদ্ধারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী, আশ্রয় শিবিরের বাইরে থাকা কিছু রোহিঙ্গাও তাদের দলে ছিল। এ ঘটনা নিয়ে সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার নাইম উল হক জানান, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে রোহিঙ্গারা। সকালে ছেঁড়াদ্বীপের কাছে হঠাৎ তাদের ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। পরে ভাসতে ভাসতে তারা যখন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে আসে, তখন সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ সময় সমুদ্র তলদেশে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে হঠাৎ ট্রলারটি ডুবে যেতে শুরু করে। ঘটনার পর পর কেউ কেউ সাঁতরে কুলে উঠে আসতে সক্ষম হয়। ভাসতে থাকে অনেকে। ইঞ্জিনবোট অভ্যন্তরে থাকাদের মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে বেশি। যাদের মধ্য থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৫টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। কোস্টগার্ড পূর্বজোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার শুভাশিস দাস জনকণ্ঠের টেকনাফ সংবাদদাতা ছলাহ উদ্দিনকে জানান, এ পর্যন্ত ১৫টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করে সেন্টমার্টিনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের কয়েকজন জানান, তাদের সঙ্গে ওই ইঞ্জিনবোটে ১৫০ যাত্রী ছিল। এদের বেশিরভাগ উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা। এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দীর্ঘদিন ধরে একটি মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করে যাচ্ছিল। যেটি ২০১২ থেকে ১৫ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করলে প্রশাসন মানবপাচারকারীদের দমন করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মানবপাচারের পয়েন্ট কক্সবাজারের পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, শহরের সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক, নুনিয়াছড়া, উখিয়ার ইনানী, সোনারপাড়া ও টেকনাফের বাহারছড়া, জালিয়াপাড়া, শাহপরীরর দ্বীপ ইত্যাদি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা দিনরাত পাহারা বসিয়ে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের দূর্গ তছনছ করে দেয়। সিন্ডিকেটের বেশকিছু দালাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণও হারিয়েছে। শীর্ষ দালালরা গা ঢাকা দিলেও রোহিঙ্গা মানবপাচারকারী দলের বেশকিছু সদস্য হাল ছাড়েনি। তারা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুকদের যোগাড়ে ব্যস্ত থাকে। কাউকে বিয়ের প্রলোভন, কাউকে চাকরি বা কাউকে মালয়েশিয়ার স্থায়ী নাগরিকত্বের প্রলোভন দিয়ে যাত্রী যোগাড় করে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের পাচার করে চলেছে। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত দশ বছরে টেকনাফ দিয়ে সমুদ্রপথে দুই লাখেরও বেশি মানবপাচার হয়েছে। এদের বেশিরভাগ মালয়েশিয়ায় গিয়ে উঠেছে। আবার অনেকের থাইল্যান্ড, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর ঘটনা রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দীর্ঘদিন সমুদ্র পথে মানবপাচার বন্ধ থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝি থেকে এ অপতৎপরতা শুরু হয়েছে।
×