ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ ট্রলারে জীবন রক্ষার সরঞ্জাম নেই

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২০ নভেম্বর ২০১৯

অধিকাংশ ট্রলারে জীবন রক্ষার সরঞ্জাম নেই

শংকর লাল দাশ, গলাচিপা, পটুয়াখালী , ১৯ নবেম্বর ॥ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সাগর ভয়াবহ উত্তাল। বইছে ঝড়ো হাওয়া। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত জারি হয়েছে। বিপদ আঁচ করতে পেরে গভীর সাগর থেকে তাই পক্ষিয়া গ্রামের রিপন খলিফা সঙ্গী ১২ জেলেকে নিয়ে ট্রলার চালিয়ে দ্রুত ফিরছিলেন তীরের দিকে। বিকেলে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে আসতেই তাদের ফিরে আসার সে খবর বাড়িতেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘটে বিপর্যয়। মাঝ সমুদ্রে ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। উত্তাল সমুদ্রে ভেসে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টারও বেশি সময় সাগরে ভেসে থেকে রবিবার ভোরে জোয়ারের ¯্রােতে জেলেরা শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন। ট্রলারের জেলে দক্ষিণ চরখালী গ্রামের নিজাম মৃধা (৪০) বলেন, ট্রলারটিতে দুটি বয়া ছাড়া জীবন রক্ষার আর কোন সরঞ্জামই ছিল না। ট্রলারটি ডুবে গেলে আমরা কেউই জীবন নিয়ে ফিরতে পারতাম না। কেবল ওপরওয়ালা আমাদের রক্ষা করেছেন। সুন্দরবনের জঙ্গল আর পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত চারদিন পরে জীবন নিয়ে কোন রকমে বাড়ি ফিরেছি। এ অভিজ্ঞতা কেবল নিজাম মৃধার একার নয়। সাগরে ইলিশ শিকারি বহু জেলে প্রায় প্রতিদিন এমন কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে যেমন সাগরে ট্রলার ডুবি ঘটছে। আবার অনেক সময়ে কুয়াশা কিংবা ডুবোচরের কারণেও ট্রলার ডুবি ঘটছে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ এবং জলদস্যুতার কবলে পড়েও ঘটছে ট্রলার ডুবি। কিন্তু পটুয়াখালীর অধিকাংশ মাছ ধরা ট্রলারে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই জেলেরা জীবন নিয়ে ফিরতে পারছেন না। সাগরের অথৈ জলরাশিতে নীরবে-নিভৃতে দিতে হচ্ছে জেলেদের প্রাণ। অথচ ট্রলারে জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে কি না, তা দেখার জন্য রয়েছে একাধিক কর্তৃপক্ষ। তারাও বিষয়টি নিয়ে তেমন তৎপর নন। পটুয়াখালীর দক্ষিণের অন্যতম মৎস্যবন্দর রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজ, মৌডুবী, বাহেরচর, গলাচিপার চরকাজল, চরবিশ্বাস, কলাপাড়ার মহিপুর, আলীপুরসহ কয়েকটি ঘাটে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের অধিকাংশ মাছ ধরা ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সংখ্যক সরঞ্জাম নেই। এরপরও ট্রলারগুলো গভীর সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করছে। ট্রলারগুলোতে জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সংখ্যক সরঞ্জাম রয়েছে কিনা, তা তদারকিও করা হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছরই মাছ ধরার ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটছে। জেলা মৎস্য দফতরসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীতে ২০ হাজারেরও বেশি ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে। যা গভীর সাগরে গিয়ে প্রধানত ইলিশ শিকার করে। অন্যান্য মাছও কমবেশি ধরা হয়। বেশ কয়েকজন জেলে ও ট্রলার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর বর্ষাকালীন ইলিশ শিকার মৌসুমের শুরু জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগরে অন্তত ৮টি ট্রলার ডুবির ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। এসব ঘটনায় তিনজন জেলের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছে কয়েকজন। গণমাধ্যমে আসেনি, এমন ট্রলার ডুবির ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। বিশেষত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ট্রলারগুলো দুর্ঘটনায় পড়লে, তার খবর লোকালয়ে খুব একটা পৌঁছে না। বিআইডব্লিউটিএর পটুয়াখালী নদী বন্দর সূত্র জানায়, মাছ ধরার প্রতিটি ট্রলারে প্রয়োজনীয়সংখ্যক লাইফ বয়া, জ্যাকেট, র‌্যাপ অর্থাৎ ভাসমান পাত্র, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, কম্পাস, রেডিও এবং প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স রাখা বাধ্যতামূলক। এসব সরঞ্জাম ও মাছ ধরার ট্রলার তদারকির দায়িত্বে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং নৌ পরিবহন অধিদফতর। পটুয়াখালীতে দফতর দু’টির কার্যক্রমও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ট্রলার এবং ইঞ্জিনচালিত নৌকা তদারকিতে তাদের খুব একটা দেখা যায় না। ফলে ঘটছে অনাখাক্সিক্ষত ঘটনা। মৎস্যবন্দরগুলোতে অপেক্ষারত জেলেরা জানান, কোনদিনই তাদের ট্রলারে প্রয়োজনীয়সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম রয়েছে কিনা, তা কেউ জানতে আসেননি। মহিপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোঃ ফজলুর রহমান গাজী বলেন, আসলেই জেলেরা তাদের জীবিকার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু তাদের ট্রলারে জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সংখ্যক সরঞ্জাম রয়েছে কিনা, তা দেখা বা পরীক্ষা করার জন্য কখনও কাউকে দেখা যায়নি। এছাড়া কিছু ট্রলারে লাইফ বয়া ও জ্যাকেট থাকলেও সেগুলো এক-দু’বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। মালিকরা প্রতি বছর এগুলো কিনতে তেমন আগ্রহী হয় না। আবার জেলেদের এগুলো ব্যবহারেও তেমন কেউ উৎসাহ দেয় না। ফলে ট্রলার ডুবি ঘটলে জেলেরা তাদের জালের সঙ্গে থাকা প্লাস্টিকের ভাসানগুলো ধরে সাগরে ভেসে থাকে। তিনি আরও বলেন, পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদীতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মাছ ধরার জন্য ট্রলার আসে। এগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকরা স্থানীয় থানায় তা জানাতে চায় না। ফলে অনেক ঘটনা অজানা থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী নদী বন্দরের পরিবহন পরিদর্শক পদে সদ্য যোগ দেয়া মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পরিবহন অধিদফতর মাছ ধরার ট্রলার রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে করে থাকে। পটুয়াখালীতেও মাছ ধরার নৌযানে জেলেদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম রয়েছে কিনা তা দেখার জন্য তাদের ওপর দায়িত্ব রয়েছে। যত শীঘ্র সম্ভব ট্রলারগুলোতে তদারকি শুরু হবে।
×