ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানিকারক থেকে রফতানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ;###; পথনক্সাই টেনে তুলছে চা শিল্প

চায়ের সুদিন আবার ফিরছে ॥ এবার রেকর্ড উৎপাদনের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১০:৫১, ১২ অক্টোবর ২০১৯

  চায়ের সুদিন আবার ফিরছে ॥ এবার রেকর্ড উৎপাদনের সম্ভাবনা

কাওসার রহমান ॥ চায়ের সুদিন আবার ফিরে আসছে। সরকারের কৌশলী উদ্যোগ ও অনুকূল আবহাওয়ায় দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। চা আমদানিকারক দেশ থেকে বাংলাদেশের আবার চা রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ বছর দেশের বাগানগুলোয় আশাতীত চা উৎপাদন বেড়েছে। চলতি ’১৯ সালের আট মাসে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে ২৩ শতাংশেরও বেশি। যা গত বছরের চেয়ে দেশে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন বৃদ্ধি। এটা শুধু দেশে নয়, বিশ্বের চা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে সবার ওপরে নিয়ে গেছে। উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে এ বছর ৯ কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদন হবে বলে আশা করছে চা বোর্ড। আর উৎপাদনের এই ধারা বজায় রাখতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আবারও বিশ্ববাজার দখলে নিতে পারবে বাংলার চা। চা বোর্ডের সর্বশেষ মাসিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের ১৬৬ চা বাগানে গত আগস্ট পর্যন্ত ৫ কোটি ২৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ৪ কোটি ২০ লাখ কেজির চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। এর আগে বছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জুন পর্যন্ত দেশের ১৬৬ বাগানে মোট ২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৮ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। গত বছর একই সময়ে ওই চা উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ৯৩ লাখ ৯৮ হাজার কেজি। সে হিসাবে বছরের প্রথমার্ধে চা উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৪৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, দেশে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের বছর ’১৬ সাল। ওই বছরের একই সময় উৎপাদন পাওয়া গিয়েছিল ৪ কোটি ৭০ লাখ কেজি। ওই বছরে মোট চা উৎপাদিত হয় ৮ কোটি ৫৫ লাখ কেজি, যা এখন পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া চা উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। অর্থাৎ রাতের বেলা বৃষ্টির পাশাপাশি দিনে খরতাপ থাকলে ভাল মানের কুঁড়ি উৎপাদন হয়। এ বছর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টি না হলেও নিয়মিত বৃষ্টিপাত ও দিনে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় দেশের বাগানগুলোয় ভাল মানের চা উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি চায়ের পরিমাণও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মদ আলী এ প্রসঙ্গে জানান, ‘শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, এ বছর চায়ের গুণগত মানও ভাল হচ্ছে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বছরে রেকর্ড চা উৎপাদনের পথে রয়েছে। ইতোমধ্যে যে পরিমাণ চা উৎপাদিত হয়েছে, তাতে নতুন রেকর্ডের ইঙ্গিত মিলছে। আবহাওয়া অনুকূল ও উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বর নাগাদ মৌসুম শেষে চা উৎপাদনের পরিমাণ ৯ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে। চা উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে বাগানমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাগানমালিকরাও এখন পুরনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা আবাদ করছেন। এমনকি পরিত্যক্ত জমিতেও চা চাষে তাক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন পরিত্যক্ত থাকা ভূমি চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালিতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা উৎপাদনে আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেছে। হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ উৎপাদনের জন্য জাতীয় পদক পাওয়া হালদা ভ্যালিতে গত বছরও উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৯ লাখ কেজি। তারা বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকে চা-চাষের উপযোগী বৃষ্টিপাত হওয়াসহ আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকা- নেয়ায় গত বছরের চেয়ে এবার দেশে চা উৎপাদন বাড়ছে। কেরামতনগর ও নন্দ রানী চা বাগানের মালিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মৌসুমের শুরু থেকে চায়ের উপযোগী বৃষ্টি হয়েছে, সূর্যের আলোও পড়েছে প্রয়োজনীয় মাত্রায়। সব মিলিয়ে আবহাওয়া রয়েছে বেশ অনুকূলে। এর ওপর বাংলাদেশ চা বোর্ডের বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে। হবিগঞ্জের দারাগাঁও চা বাগানের ম্যানেজার ফরিদ আহমদ শাহিন বলেন, ‘অনুকূল পরিবেশ থাকায় চা উৎপাদন বেড়েছে। বছরের প্রথম দিকে চা উৎপাদন কম হলেও এখন তা প্রায় দ্বিগুণ। চা বোর্ডের উৎপাদন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘১৮ সালের শেষের ছয় মাসে মোট সাড়ে ছয় কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। ফলে প্রথম ছয় মাসের উৎপাদন মিলিয়ে নয় কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ শত মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের দেশে পরিণত হবে। তখন চা আমদানির পরিবর্তে বাংলাদেশ আবারও রফতানিমুখী চায়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। চা বোর্ডের শ্রীমঙ্গলের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক কে এম রফিকুল হক বলেন, ‘এখন আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূলে। প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়েছে। ফলে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চা-পাতা সংগ্রহ করা যাবে। তখন উৎপাদন ৯ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিনি জানান, চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে এগিয়ে। গত জুলাইয়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে চা উৎপাদন বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এই হার প্রতিবেশী ভারতে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং আরেক বড় চা উৎপাদনকারী দেশ শ্রীলঙ্কায় মাত্র দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ ছাড়া কেনিয়ার মতো চা উৎপাদনকারী দেশে তো ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমেছে। এতে বাংলাদেশের সামনে আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি বলেন, উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এ বছর দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল চা রফতানিও করা যাবে। রফিকুল হক বলেন, এবার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিটি বাগানের পরিত্যক্ত জমিকে চা-চাষের আওতায় আনা হয়েছে, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাটে ক্ষুদ্রায়তনে চা-চাষ বেড়েছে, চা গবেষণা কেন্দ্র চায়ের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে চা উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান জি এম শিবলী বলেন, দেশে চায়ের দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদন হয় মৌলভীবাজারের ৯২ বাগানে। তবে অনুকূল আবহাওয়া না থাকাসহ নানা জটিলতায় বিগত দুই বছর ধরে চায়ের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। পরে বাগান কর্তৃপক্ষ ও চা বোর্ডের নানামুখী পদক্ষেপে এ বছরে চায়ের উৎপাদন রেকর্ড বাড়তে থাকে। অনুকূল আবহাওয়া বজায় থাকলে গত বছরের চায়ের উৎপাদন ৮২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে এ বছর ডিসেম্বরে ৯০ মিলিয়ন কেজির লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আমাদের আর সেভাবে চা আমদানি করতে হবে না। তিনি বলেন, আবহাওয়াসহ অন্যান্য বিষয় যদি ঠিক থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা সারাদেশে এক লাখ ৩০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের রেকর্ডও করব, যখন আমরা আগের মতো আবার চা অন্যান্য দেশে রফতানি করতে পারব। উল্লেখ্য, ’১৮ সালে বাংলাদেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ছিল ৯০ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন কেজি। আর উৎপাদন ছিল ৮২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন কেজি। বাকি চা অন্যদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছিল। এ বছর চায়ের গড় উৎপাদন ৯০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে গেলে বিদেশে থেকে আর চার আমদানির খুব এক প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স এ্যান্ড প্ল্যান্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জহর তরফদার জানান, এখন শ্রীমঙ্গলেই সরাসরি নিলাম হওয়ায় চায়ের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে না। আর গুণগত মান ঠিক রেখে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে চায়ের স্বর্ণযুগ আসবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছরও অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে চা বাগানে। বৃষ্টিধারায় ভিজতে ভিজতে চায়ের সবুজ কুঁড়িগুলো ভালভাবেই ছড়াচ্ছে। আর এই কুঁড়িতেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। মুঠো মুঠো সবুজ কুঁড়িই ধরা দিচ্ছে চা শিল্পে সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে। ফলে এবারও দেশে চা উৎপাদনে বড় রেকর্ড হতে চলেছে। আবহাওয়া অধিদফতর সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, চলতি বছরে সিলেটে মোট বৃষ্টিপাত প্রায় ৩ হাজার ৩১৫ মিলিমিটার। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ দশমিক ২ মিমি, মার্চে ৪৬ দশমিক ৯ মিমি, এপ্রিলে ৩২৬ মিমি, মে মাসে ৬৫৬ দশমিক ৫ মিমি, জুনে ৮০৮ দশমিক ৩ মিমি, জুলাইয়ে ৭১৯ দশমিক ৪ মিমি, ৪০৫ দশমিক ১ মিমি এবং সেপ্টেম্বরে ৩০৮ মিলিমিটার। যদিও জানুয়ারিতে কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। সবমিলে আমাদের বিভাগে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। যা চায়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী। চা উৎপাদন বৃদ্ধির ইতিহাস ॥ এর আগে চা উৎপাদনের ইতিহাসে ’১৬ সালে ১৬২ বছরের ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেশে সর্বোচ্চ ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। কিন্তু পরের বছরেই এর উৎপাদন কমে ৭ কোটি ৮০ লাখ কেজিতে দাঁড়ায়। তবে ’১৮ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যা দেশের চা উৎপাদনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। এ হিসাবে গত বছর ৪ হাজার ১০৫ কোটি কাপ চা (প্রতি ২ গ্রা মে এক কাপ চা) হয়েছে দেশে। ’১৭ সালে চা উৎপাদন হয়েছিল ৭ কোটি ৮৯ লাখ কেজি। গত বছরের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে ৩১ লাখ কেজি বা ৪ শতাংশ। চা উৎপাদনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হয় ’১৬ সালে। সে বছর সাড়ে ৮ কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়। ’১৬ সালে চা চাষে পুরোপুরি অনুকূল আবহাওয়ার মধ্যে রেকর্ড হয়েছিল। গত বছর প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে ভাল হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাগানের মালিক ও চা বোর্ড কর্মকর্তারা। চা বোর্ডও এবার ৭ কোটি ২৩ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন ৯৭ লাখ কেজি বা ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছরের গড় উৎপাদন হিসাব করে চায়ের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা হিসাব করা হয়। গত ৩ বছরে গড় উৎপাদন ৮ কোটি ২০ লাখ কেজি। এর আগের ৩ বছরে (২০১৩-২০১৫) ছিল ৬ কোটি ৫৮ লাখ কেজি। পথনক্সাই টেনে তুলছে চা শিল্পকে ॥ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলার চায়ের এক চেটিয়া আধিপত্য ছিল। কিন্তু এক সময় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজার থেকে ছিটকে পড়ে বাংলাদেশের চা। শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে শুরু করে রফতানির পরিমাণ। এরই ধারাবাহিতকায় ২০১৫ সালে চা রফতানি হয় মাত্র দশমিক ৪৯ মিলিয়ন কেজি। আর চা শিল্পকে এখান থেকেই টেনে তুলে আবারও বিশ্ববাজারে হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে ২০১৫ সালে মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। চা শিল্পের উন্নয়নে পথনক্সা- নামে একটি কর্মকৌশল তৈরি করা হয়েছিল। ১৫ বছর মেয়াদী এই পথনক্সায় চায়ের উৎপাদন ১৩২ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে কমপক্ষে ২৫ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রফতানি করা যাবে এমন টার্গেট ধরে রাখা হয়। চায়ের উৎপাদন বাড়াতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করায় গত তিন বছরে দেশে গড়ে বছরে ১২ মিলিয়ন কেজি করে চা বেশি উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘বাগানমালিকরা এখন পুরনো চা গাছ তুলে নতুন চারা লাগাচ্ছেন। একইভাবে নতুন করে বাগানের পরিধিও বাড়ানো হচ্ছে, যে কারণে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। তিনি বলেন, গত শতকের সত্তরের দশকে দেশে চায়ের উৎপাদন হতো ৩০ মিলিয়ন কেজি। আর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ছিল মাত্র ৫ মিলিয়ন কেজি। তখন চা রফতানি করা যেত। আর এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৯০ মিলিয়ন, আর উৎপাদন হচ্ছে ৮২ মিলিয়ন। তা হলে রফতানি করব কীভাবে। চা-বাগানের মালিকরা জানান, চা শিল্পে আবার আশার আলো দেখা যাচ্ছে। উৎপাদনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই আমরা আবার বিদেশে চা রফতানি করতে পারব। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মোঃ মুনির আহমেদ বলেন, ‘ওই পথনক্সার পথ ধরেই চা শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। পথনক্সা না করলে এ বছর আমাদের উৎপাদন থাকতো ৬৫ মিলিয়ন কেজি।’ তিনি বলেন, ‘বাগানমালিকরা এখন চায়ের প্লানটেশন বাড়াচ্ছেন। বিশেষ করে উপড়ের দিকে চায়ের প্লান টেশন অনেক বেশি হয়েছে।’ চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন নবম ॥ সঠিক সময়ে কীটনাশক ব্যবহার এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চা উৎপাদনে এই সফলতা এসেছে বলে চা-বাগান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল চা কমিটির তথ্য মতে, চীন এখন চা উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে। আর ভারত আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। বিশ্বে চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন নবম স্থানে। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ একটানা দশম অবস্থানে ছিল। যা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার চা শিল্পের জন্য সুখবর। গত শতাব্দীর শেষে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম, ১৯৮৯ সালে ছিল ১২তম। চা উৎপাদনে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের নিচে আছে জাপান, উগান্ডা, নেপাল, ইরান, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো। ইন্টারন্যাশনাল চা কমিটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের সামনে চায়ের উৎপাদন দ্বিগুণ করার সুযোগ রয়েছে। চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি মোঃ শাহ আলম বলেন, কিছুটা প্রতিকূল আবহাওয়া বিবেচনায় নিলে এবার চা উৎপাদন খুবই ভাল হয়েছে। চা বাগানগুলোতে এখন পুরনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা লাগানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কয়েক বছর ধরে চলছে। তাতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী দিনে চা উৎপাদন যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। ২০০৯ সালে চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য নেওয়া কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চা চাষের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। সমতল ভূমিতে চা চাষ হচ্ছে। চা চাষের নতুন এলাকা উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। যেমন ২০১৭ সালে উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫৪ লাখ কেজি। গত বছর উৎপাদন ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৫ লাখ কেজি। বান্দরবানের রুমায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ দিকে চা গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চা বাগানের জমি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। মাত্র ৫২ ভাগ জমি চা চাষের যোগ্য। বাকি ৪৮ ভাগ জমি পতিত ও চা চাষের জন্য লিজ নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার হচ্ছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা, লিজ নেয়া জমির সঠিক ব্যবহার, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, সঠিক মনিটরিং, কম মূল্যে সার-কীটনাশক সরবরাহ ও ক্লোনিং চা গাছ রোপণ করলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ বলেন, চা চাষের আওতা ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চা উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে। চা বোর্ড থেকে তদারকি করা হচ্ছে। সরকার এ খাতে উৎপাদন বাড়াতে যে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে তার কারণেই গত বছর কিছুটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও উৎপাদনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। ৮ বছর আগেও এ অবস্থা ছিল না চা শিল্পে। উল্টো ২০১০ সাল থেকে চা আমদানি শুরু হয়। শঙ্কা ছিল চা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। তবে এখন চাহিদার কাছাকাছি উৎপাদন হওয়ায় আমদানিও কমেছে। গত বছর চা বোর্ড ৬৫ লাখ কেজি চা আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনুমতি দিয়েছে। অবশ্য দেশে ভোগ বাড়ায় চা রফতানি কমেছে। গত বছর (২০১৮) সাড়ে ৬ লাখ কেজি চা রফতানি হয়। বাংলাদেশ থেকে চা রফতানি হচ্ছে পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ২০১০ সাল থেকে চা শিল্প নিয়ে যে শঙ্কার তৈরি হয়েছিল এ মৌসুমের উৎপাদনে তা কেটে যাচ্ছে। চা ব্যবসায়ীদের সংগঠন টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও চা ব্যবসায় শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শান্তনু বিশ্বাস বলেন, উৎপাদন বাড়ায় বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। এ মৌসুমের ৩৭টি নিলামে চায়ের গড় দাম উঠেছে কেজিপ্রতি ২৭০ টাকা, যা অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। এখন দেশে চায়ের বাজারের আকার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের সময় দেশে ১৫০ চা-বাগান ছিল। তখন দেশে ৩ কোটি কেজির মতো উৎপাদন হতো। বর্তমানে দেশে ১৬৬ চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারেই রয়েছে ৯২ চা বাগান। অন্যান্য চা বাগানের মধ্যে হবিগঞ্জে ২৪, সিলেটে ১৯, চট্টগ্রামে ২২, পঞ্চগড়ে ৭, রাঙ্গামাটিতে ২ ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান রয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে রয়েছে বেশি কিছু ক্ষুদ্র চা বাগান। চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০১২ সালে হয়েছিল ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। ছত্রাকনাশকের নেতিবচক প্রভাব! চা বাগানে ছিটানো হচ্ছে অতিমাত্রায় ছত্রাকনাশক ওষুধ। ওষুধটির নাম ‘কপার অক্সিক্লোরাইড’। এর অতিমাত্রা প্রয়োগে চা গাছে ক্ষতিকর প্রভাবসহ রয়েছে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকও। শুধু তাই নয়, এমন রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপরও পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। চা বাগানের সর্দার বা কীটনাশক শ্রমিকরা ভুলবশত এমন ছত্রাকনাশক মিশ্রণটি প্রয়োগ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই কোন নজরদারি। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) সূত্র জানায়, কপার অক্সিক্লোরাইড মূলত ছত্রাকের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করা হয়। চা পাতার বাড়ন্ত পর্যায়ে পাতা ঝলসানো রোগ ও পাতার দাগ রোগ দূরীকরণেও এটি ব্যবহৃত হয়। এটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণে পানির সঙ্গে সংমিশ্রণ না করে মাত্রাতিরিক্ত বা অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হলে এর ক্ষতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কমলগঞ্জ উপজেলার মিরতিঙ্গা চা বাগানের একটি সেকশনে সম্প্রতি এভাবে অতিমাত্রায় ছত্রাকনাশক স্প্রে করা হয়েছে। দ্রবণটিতে চা পাতা শুকিয়ে সাদা রং ধারণ করেছে। সেকশনের বেশ কিছু জায়গায় এমন বেশি মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। মিরতিঙ্গা চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক আমিনুল রহমান বলেন, আসলে অতিমাত্রায় কপার অক্সিক্লোরাইড এখানে ব্যবহার করা হয়নি। মূলত বিটিআরআইর নির্দেশনা মেনেই চা গাছের দৈহিক সুরক্ষার জন্য তা স্প্রে করা হয়েছে। এতে কোন প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। এ বিষয়ে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রায়হান মজিদ হিমেল বলেন, কপার অক্সিক্লোরাইড চা গাছের পাতায় স্প্রে করলে সাধারণত সাদা সাদা দাগ থাকে। এজন্য আমরা প্রতিটি বাগানকেই সাজেস্ট করি যে, প্লাকিংয়ের (পাতা চয়ন) পরে তা সুনির্দিষ্ট মাত্রায় স্প্রে করতে। তাহলে ৭ থেকে ১০ দিন পরে যখন পাতা তুলতে এলে তখন আর চা পাতার উপরের ওই দাগ আর থাকে না। কিন্তু প্লাকিংয়ের আগে স্প্রে করে তাহলে সাদা সাদা দাগ ফুটে ওঠাসহ স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকটি থেকেই যায়। তিনি বলেন, যে কোন ওষুধই তার নির্দিষ্ট পরিমাণ থেকে অতিরিক্ত মিশ্রণ করে প্রয়োগ করা হলে উপকারের চেয়ে তার ক্ষতির দিকটিই বেড়ে যায়। এজন্য আমরা চা বাগানগুলোকে বারবার বলি যে চা পাতা তোলার পরপরই আমাদের বিটিআরআই পরীক্ষিত রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করতে। তাহলে নতুন কুঁড়ি থেকে বা দেড় সপ্তাহ পর তোলা হলে ততদিনে রৌদ্রতাপ বা বৃষ্টিতে ও চা গাছের পাতায় জমে থাকা রাসায়নিক পদার্থগুলোর ক্ষতিকর দিকটি আর থাকে না। ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকটি তখন নেই বললেই চলে। চা বাগানগুলো মূলত বড় বড় ড্রাম ব্যবহার করে। ২০০ লিটারের সেই ড্রামে প্রায় ৫০০ বা ৫৫০ গ্রাম ওষুধ মিশ্রণই হলো আমাদের নির্দেশিত সঠিক মিশ্রণ পদ্ধতি। এর কম বা বেশি দুটি প্রকারই এই ছত্রাকনাশকের কার্যকারিতা ব্যর্থ করবে বলে তিনি জানান ।
×