ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরি শেষে পেনশন- বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের স্বপ্নপূরণ

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  চাকরি শেষে পেনশন- বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের স্বপ্নপূরণ

গৌতম পান্ডে ॥ ‘দোতারা বাজিয়ে জীবনের সোনালি দিনগুলো বেতারেই কাটিয়ে দিলাম। অনেক গুণী শিল্পীর সঙ্গে যন্ত্রী হয়ে বাজানোর সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু জীবন ছিল অনিশ্চিত। বহুদিনের সে ইচ্ছাটা পূরণ হলো। শেষ জীবনে আমাদের মতো মানুষদের কেউ আর দুস্থ শিল্পী বলবে না। চাকরি শেষে এখন আর আমাদের খালি হাতে ফিরতে হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বহুদিনের আশাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এখন থেকে চাকরি শেষে আমরা পেনশন পাব। আমরা অত্যন্ত খুশি। এবার জীবনটার একটা সুরাহা হলো। এতদিন যে কাজ করছি, সেটা সার্থক হলো-বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের প্রথমবারের মতো পেনশন প্রথা চালু করায় এভাবে অনুভূতি প্রকাশ করেন দোতারাবাদক রতন রায়। কথায় সুর মিলিয়ে বেতারের আরেক নিজস্ব শিল্পী তবলা বাদক জগন্নাথ ব্যানার্জী বলেন, সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যদিয়ে জীবন কাটিয়ে ষাট-সত্তর বছর বয়সে এসে কোন শিল্পীর রিক্তহস্তে ফিরে যাওয়া যে কত কষ্টের, কত বেদনার তা উপলব্ধি করেছেন আমাদের বেতারেরই অনেক নিজস্ব গুণী শিল্পী। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন অনেকেই। বেতারের জন্মের পর থেকে কনটাক্ট সার্ভিসের মতো তারা কাজ করতেন। রিটায়ারমেন্টে গেলে শূন্য হাতে যেতে হতো, কেউ কিছু পেতেন না। তারা দুস্থ শিল্পী বলে পরিগণিত হতেন। স্বনামধন্য গুণী শিল্পী সমর দাশ, আবদুল হাইরা এ ব্যথা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই অভিশপ্ত জীবন থেকে আজ আমরা কিছুটা হলেও মুক্ত হয়েছি। এবং এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতায়। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা চিরঋণী। একই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, তথ্যসচিব আবদুল মালেক, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র শীল ও উপ-পরিচালক হালিমা বেগম, শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, শিমিন হোসেন রিমি ও শিল্পী মেহরিন প্রমুখকে। তাদের সহযোগিতা না থাকলে এটা সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই অঞ্চলে প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা কেন্দ্র নামে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এর কার্যক্রমের শুরু থেকে কর্মচারী-কর্মকর্তা ছাড়াও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, নাটক, উপস্থাপনা, লেখক, সংবাদ পাঠক ইত্যাদি নানা বিষয়ে পারদর্শী প্রতিভাবান সৃজনশীল ব্যক্তিদের প্রয়োজন পড়ে এবং দক্ষতার জন্যে তাদের নিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রথা চালু করা হয়। এসব স্বনামধন্য ব্যক্তি ‘নিজস্ব শিল্পী’ নামে পরিচিতি পান। এতকাল এই নিজস্ব শিল্পীদের নিয়োগ ছিল চুক্তিভিত্তিক। ফলে সারা জীবন বেতারে কাজ করেও বিদায়বেলায় তারা কিছুই পেতেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বেতারের এই নিজস্ব শিল্পীদের চাকরি পেনশনের আওতায় এলো। গত ৮ আগস্ট থেকে প্রথমবারের মতো এ প্রথা চালু হলো। তবলাশিল্পী জগন্নাথ ব্যানার্জী বিশেষ করে উল্লেখ করেন তথ্যসচিব আবদুল মালেকের সহযোগিতার কথা। তিনি বলেন, তথ্যসচিবের কাছে আমরা যখনই গেছি, তিনি আমাদের কথাটি আমলে নিয়ে বলেছেন, চিন্তা করবেন না, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন এটা হবেই। যেখানে যে সমস্যা ছিল সব কিছু উনি দেখে দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকা এই কাজটি স্বল্পসময়ে সম্পন্ন করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের পেনশন, শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ভাতা ও টাইম স্কেল দেয়ার বিষয়ে তথ্যসচিব আবদুল মালেক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহতী অবদান ও অনুগ্রহেই আমাদের এই প্রাপ্তি। ঢাকায় প্রথম বেতার কেন্দ্র উদ্বোধন করেন সে সময়ের অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরই বাংলা একে ফজলুল হক। সে সময় বাণী পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন কালজয়ী গান ‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম আমার গানের সুর গো’। একই সময়ে প্রথম নাটক বুদ্ধদেব বসুর ‘কাঠ ঠোকরা’। আরেকটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। অবিভক্ত ভারতের খ্যাতিমান অনেকেই কাজ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছে চিত্রনায়িকা মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা বিকাশ রায়, কবি শামসুর রাহমান, কবি বন্দে আলী মিয়া, প-িত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সঙ্গীতজ্ঞ সুধীর লাল চক্রবর্তী, কানাইলাল শীল, ফটিক দত্ত, অজিত রায়, আবদুল আহাদ, সমর দাস, উস্তাদ মীর কাশেম খান, আবেদ হোসেন খান, ধীর আলী, মনসুর আলী, রণেন কুশারী, সুবল দত্ত, সুজেয় শ্যাম প্রমুখ। পরবর্তীকালেও এই গুণী শিল্পীরা নিজস্ব শিল্পী নামে অভিহিত হয়ে তদানীন্তন বাংলাদেশ বেতার পর্যন্ত কাজ করেছেন। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী সংস্থার সদস্য সচিব জগন্নাথ ব্যানার্জী জানান, দেশ স্বাধীনের পরে এই শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্টখ্যাত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিজস্ব শিল্পী ছিলেন। বেতারে অসামান্য অবদানের জন্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে যখন এই গুণী শিল্পীরা দেখা করতে যান, তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা তো আমার শব্দসৈনিক। এসব শব্দসৈনিক তখন দাবি করেন যে, দেশ তো স্বাধীন হলো, আমরা শিল্পী মানুষ, আমাদের চাকরির জন্য একটা নিশ্চয়তা চাই, যাতে জীবনের শেষ বেলায় একটু ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারি। ’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক এদের চাকরি সরকারীকরণের নির্দেশ দেন। তখন প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজস্ব শিল্পীদের জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করে চাকরি সরকারীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের চাকরি সরকারীকরণের এই প্রক্রিয়া থেমে যায়। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ৯৭ সালে সে সময়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডাঃ এস এ মালেককে বাংলাদেশ বেতারে পাঠান। তিনি সাত সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিও সুপারিশ করে বেতাদের নিজস্ব শিল্পীদের চাকরি পেনশানভুক্ত করার। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে সময়ের তথ্যসচিব ব্যারিস্টার হায়দার আলী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাজ আমরা কেন বাস্তবায়ন করব বলে ওই সুপারিশের কাগজ ফেলে দেয়া হয়। জগন্নাথ জানান, পরবর্তীকালে আবার যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন, তখন আমরা বিভিন্ন সংসদ নেতার কাছে যাই। সংসদে প্রথম পঞ্চানন বিশ্বাস ৭১ বিধিতে আমাদের কথা উপস্থাপন করেন। এ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম এমপিও শিল্পীদের দুর্দশার কথা উপস্থাপন করেছেন। ময়মনসিংহের এমপি মমতাজ বেগমও আমাদের কথা তোলেন। এরপর ’১৩ সালে আমরা গেলাম সংসদীয় তথ্যমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে। একে এম রহমত উল্লাহ আমাদের কথাবার্তা শোনার পর তারানা হালিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটা সাব কমিটি গঠন করে দিলেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাশ ও কক্সবাজারের এমপি সায়মুন সরোয়ার কমল। ওনারা আশ্বাস দিলেন এটা হবে। এরপর ’১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেতারের হীরকজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের চাকরি পেনশনের আওতায় আনা হবে। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দরজায় ঘোরার পর নানা প্রতিবন্ধকতা শেষ করে বর্তমান বেতারের মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র শীলের দক্ষতা ও আমাদের ডেস্ক অফিসার হালিমা বেগমের আন্তরিকতায় এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। সর্বোপরি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মনে করেছেন এটা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন এটা হতেই হবে। জগন্নাথ ব্যানার্জী বলেন, বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের পেনশন, শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ভাতা, টাইম স্কেল ছিল না যদিও টাইম স্কেল ১৫ সালের পে-স্কেলের পরে সরকার বন্ধ করে দেয়, তার জন্যে ধারাবাহিক ইনক্রিমেন্ট এ্যাড হবে। আমরা পেতাম একটি মাত্র গ্র্যাচুইটি। নিজস্ব শিল্পীদের এ সাফল্য বাংলাদেশ বেতারের বর্তমান মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র শীল বলেন, যে কাজটা করা হয়েছে এদের অনেকেই সে বিষয়ে অবগত নন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ঘোষণা দিলেন যে ২৯৫ পদ সরকারী হবে। অনুষ্ঠান পরিচালক কামাল আহমেদ বলেন, এটা আমাদের কাছে একটা বড় অর্জন। রেডিও প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই দীর্ঘ সময় ছিল তাদের একটি বঞ্চনার। আমি মনে করি এটি বড় অর্জন। আমরা সবাই একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, আমরা পেনশন পাচ্ছি আমাদের সহকর্মীরা পাচ্ছেন না এটা আমাদের অন্যরকম একটা ব্যথা ছিল। সেই জায়গাটা থেকে অন্তত রিলিজ পাওয়া গেল। সঙ্গীত প্রযোজক ও বেতারের নিজস্ব শিল্পী সংস্থার আহ্বায়ক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, সবাই খুশি, তবে একটি বিষয়ে আমরা এখনও অখুশি। নিজস্ব শিল্পীদের যে বেতন স্কেল সেটা তুলনামূলকভাবে শিল্পকলা একাডেমি অথবা বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি নির্ধারণ করা হতো তাহলে আমাদের জন্য ভাল হতো। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিটিভির এক যন্ত্রী যে স্কেলে চাকরি করছেন একই মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ বেতারের জন্য সেটা কেন প্রযোজ্য নয়, এটা একেবারেই বেমানান। সঙ্গীত প্রযোজক ও বেতারের নিজস্ব শিল্পী সংস্থার সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, অসম্ভব রকমের এক ভাললাগা কাজ করছে, যা প্রকাশ করার মতো নয়। সঙ্গীত প্রযোজক শাহীন সরদার বলেন, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, চির ঋণী।
×