ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

লাগামহীন বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় টিভি নাটক দর্শকপ্রিয়তা হারাচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

লাগামহীন বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় টিভি নাটক দর্শকপ্রিয়তা হারাচ্ছে

গৌতম পাণ্ডে ॥ এক সময়ে ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘শুকতারা’, ‘সংশপ্তক’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘রূপনগর’, ‘আজ রবিবার’, ‘জোনাকী জ্বলে’ ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখার জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় উন্মুখ হয়ে থাকত দর্শক। নব্বই দশকেও দর্শকের বিনোদন চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়নি বিটিভি। তখন বিটিভিই ছিল দর্শকদের একমাত্র বিনোদনের ভরসা। সেসব নাটকের দেখার পর গল্প বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় নিয়ে চলত আলোচনা। নব্বই পরবর্তী সময়ে একমাত্র টেরেস্ট্রিয়াল চ্যানেল একুশে টিভি নানামাত্রিক নাটক দিয়ে মুগ্ধতায় ভাসিয়েছে পুরো দেশ। সে সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতার দর্শকও বাংলাদেশের চ্যানেলের ভালমানের নাটক দেখতে পছন্দ করত। অথচ ক্যাবল-স্যাটেলাইটের যুগে এখন কলকাতার দর্শকের বিটিভি বা অন্যান্য চ্যানেল দেখতে হয় না। নন-ফিকশন কিংবা রিয়েলিটি শোতে বাংলাদেশের টিভিওয়ালারা কখনও সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন না। বরাবরই ভরসার জায়গা ছিল নাটক। এখন সেই নাটক থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শক। ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের দিকে ক্রমশ পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশী নাটকের দর্শক। পাশাপাশি দেশী বিজ্ঞাপন বাজারও এখন রফতানি হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে। অর্থনৈতিক দৈন্য আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে যাচ্ছেতাই অবস্থা দেশের দুই ডজনেরও অধিক টিভি চ্যানেলে। দিন দিন বেড়ে চলেছে মানহীন নাটকের সংখ্যা। মাঝে মধ্যে দু-একটি ভাল মানের নাটক সম্প্রচার হলেও লাগামহীন বিজ্ঞাপনে দর্শকদের রিমোট হাতে আর স্থির থাকছে না। সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে স্টার প্লাস, জি বাংলা, কালারস, সনি বা স্টার জলসায়। অনেক আগেই বিটিভির ওপর থেকে দর্শক আকর্ষণ হারিয়েছে। ভরসা ছিল স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর। কিন্তু সেখানেও চলছে নাটকের নামে বিরামহীন বিজ্ঞাপনের অত্যাচার। তার ওপর বেশিরভাগ নাটকই গল্পহীন-অর্থহীন। দেশের এতগুলো টিভি চ্যানেলের মধ্যে বেশিরভাগে প্রচার হওয়া অসংখ্য খণ্ড ও ধারাবাহিক নাটকের খবর ও নাম খুঁজে পাওয়া যায় শুধু দৈনিক পত্রিকার টিভিসূচীতে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের টিভি নাটকের ভবিষ্যত কী, এখন কি আর ভাল নাটক নির্মাণ করা হয় না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্বনামধন্য নাট্যকার, নির্মাতা ও প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবশ্যই, এখনও ভাল নাটক নির্মাণ হয়। না হলে এতগুলো চ্যানেলে এত এত নাটক চলে কী করে? নাট্যকার সংঘের সভাপতি মাসুম রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, টিভি নাটক থেকে দর্শক বিমুখ হয়ে গেছে এটা সত্য। বেশি ভালর দিকে আমাদের নাটক যাচ্ছে না এটাও সত্য। তবে এটা নাটকের মানের কারণে নয়। এর পেছনের অব্যবস্থাপনায় ভালর দিকে যাচ্ছে না। না চ্যানেল, না প্রডিউসার, না এজেন্সি কেউ নাটকটাকে শিল্প হিসেবে দেখছে না। বরং বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখছে। তার থেকে তারা নিজেরা কতটুকু লাভবান হবে এটুকুই দেখছে। ফলে নাটকের ভবিষ্যত যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একটা নাটক করার জন্য তো পদ্ধতি আছে। নাটকটা চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা হবে, সেটা তারা দেখবেন, পছন্দ হলে প্রচার করবেন এই হচ্ছে প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু এখন সে নিয়ম আর নেই। এই নিয়মে অনেক ব্যত্যয় ঘটেছে। তারা চাইছেন আর্থিক বিষয়কে মুখ্য করতে। চ্যানেল মনে করছে নাটকটি দর্শক দেখল, কি দেখল না তাদের কিছু যায় আসে না। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কিÑ প্রশ্নের জবাবে মাসুম রেজা বলেন, আমি মনে করি পুরো চ্যানেল, ডিরেক্টর, প্রডিউসার, এজেন্সি সবাই মিলে বসে এটা যে একটা শিল্পকর্ম, সেই সিন্ধান্তে আগে উপনীত হতে হবে। এটি কোন বাণিজ্যিক পণ্য নয়। এ প্রসঙ্গে নাট্যজন আলী যাকের জনকণ্ঠকে বলেন, একই টিভি চ্যানেলে কতিপয় নাট্যকারের নাটক দীর্ঘদিন চালালে গল্পের নতুনত্ব কমে যায়। আমাদের দেশে সেটিই হচ্ছে। গল্পের বৈচিত্র্য না থাকলে তো দর্শক টানা যায় না। টিভি নাটকের মান নিয়ে বলাও মুশকিল, কেননা এতগুলো চ্যানেলের জন্য প্রোগ্রাম দরকার হচ্ছে এবং সেগুলো যার যে রকম মেধা তাই দিয়ে তৈরি করছে। ফলে নাটকের মানও নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার একগাদা লোক এর উপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা চালায়, তাদের কথাও ভাবতে হবে। সব দিক এখন একটা সুতোয় জড়িয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের মতো ভাল লেখক এলে কিংবা ইমদাদুল হক যদি আবার যতœ নিয়ে লিখতে আরম্ভ করে তখন দর্শক এদিকে ফিরবে। এখন নতুন কোন পথ সৃষ্টি করতে না পারলে এ থেকে উত্তরণ ঘটবে না। আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যদি একটু ভাল বা শক্তিশালী হতো, যেটাকে বলা হয় লেজে হাওয়া পাওয়া, তাহলে হয়ত এদিকটা ভাল হতো। মুশকিল তো ওইখানে, এখন দর্শককে যা দেয়া হয় তাই দেখে। তবে টিভি নাটক একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, পত্র পত্রিকায় নাটক নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়। ফলে চলছে কোন রকমে। আমি টেলিভিশনে খুব কম কাজ করি। আমার কাজটা মঞ্চ ঘিরে। সেখানে অর্থনৈতিক কোন কমিটমেন্ট নেই, ফলে আমি মন খুলে কাজ করতে পারি। যেহেতু আমি জনপ্রিয়তার দিকে তাকিয়ে নেই। কিন্তু সেই জিনিসটা টিভি নাটকের ক্ষেত্রে সত্য নয়। এখানে যারা নাটক লেখেন, তৈরি করেন, অভিনয় করেন সেটাই তাদের পেশা। তাদের দেখতে হয় কোন নাটকটা কিভাবে করলে জনপ্রিয় হয়। সেখানে একটা দ্বন্দ্ব লাগে। সেই সম্পর্কে হয়ত একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গেও একই জিনিস চলছে। এখন তারা সিনেমা দেখাচ্ছে। আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, তখন আমি কলকাতার দুরদর্শন ডিডি বাংলায় একটা সিনেমা দেখছি। সেখানে সব্যসাচী, পরমব্রতসহ কিছু ভাল অভিনেতা আছে। একটু ভিন্ন স্বাদের সিনেমা। ভালও লাগছে সিনেমাটি। কিন্তু ওখানকার নাটক গতানুগতিক চলছে। আমি মনে করি টিভি নাটকে বৈচিত্র্য আনতে হবে, তাহলে দর্শকপ্রিয়তা পাওয়া যাবে। বাজেট সঙ্কট এবং বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যের কারণে টিভি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শক। বললেন আরেক নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ভালর দিকে যাচ্ছে না আমাদের দেশের টিভি নাটক। নাটকে বাজেট নাই। এই ধরুন, সামনে খেলা শুরু হবে, বাজেট আরও কমে যাবে। বাজেট যত কমবে নাটকের মান তত নি¤œমুখী হবে। এত নাটকের চাপ, ভাল শিল্পী, টেকনিশিয়ান কম যার ফলে ভাল নাটক হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে ওয়েব সিরিজ শুরু হয়েছে। ইউটিউবে দর্শক নাটক দেখে। কাজেই মানুষের মনোযোগ ও দিকে যাচ্ছে। ওতে বাজেটও বেশি। আজকের দিনে তো সব কিছুর পেছনে টাকা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর এতে এজেন্সি ঢুকে গেছে। তারা প্রচুর মুনাফা করে। একচুয়ালী প্রডিউসার, ডিরেক্টর ও শিল্পীর হাতে যে টাকাটা পৌঁছায় সেটা একেবারেই অপ্রতুল। টিভির বিশৃঙ্খলা তো আছেই। আর বাংলাদেশের নাটক দর্শক কেন দেখবে? নাটক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে পরিমাণে বিজ্ঞাপন চলে। ২০ মিনিটের নাটকে যদি ৪০ মিনিট বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে কে দেখবে নাটক? টিভি চ্যানেল বা এজেন্সি থেকে বলা হয় অমুখ শিল্পীকে নেন, না হলে হবে না। এজেন্সির দৌরাত্ম্যে তাদের রেটও বেশি। নাটকে যেসব আর্টিস্টদের আমরা দেখি এদের দেখতে চায় না দর্শক। চ্যানেলগুলোর ভাল নাটকের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তারা শুধু টাইম ভরাতে চায়। কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। এদিক থেকে বিটিভি এখনও একটা ভাল জায়গায় আছে, কারণ বিটিভিতে বিজ্ঞাপন কম। দেশের টিভি নাটকের উন্নয়নে সরকারের হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মামুনুর রশীদের কথার সঙ্গে একমত নন স্যাটেলাইট চ্যানেল আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এখন তো বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। ও কথা এখন আর কেউ বলতে পারবে না। আমরা দেখেছি যে ভাল নাটকে বিজ্ঞাপন থাকলেও দর্শক সরে যায় না। টিভি নাটকে দর্শকের আগ্রহ কমে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দর্শকের আগ্রহ কমে আসছে না। যারা ভাল নাটক বানাচ্ছে তাদের নাটক অবশ্যই দেখছে। যেমন ধরুন আমাদের আরটিভির নাটকগুলো ডিফারেন্ট হয়। মানুষ এসব নাটক দেখার জন্য টিভির সামনে বসে থাকে। সে জন্য আমাদের সিআরপিও ভাল। এখন যদি আপনি নাটক বানানোর নামে আলতু-ফালতু জিনিস তৈরি করেন, তাহলে তো মানুষ দেখবে না। দর্শকের সঙ্গে তো প্রতারণা করা যায় না। দর্শককে ভাল জিনিস দিলে দেখবে, না দিলে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তিনি বলেন, আমাদের আরটিভির নাটকের দারুণ ডিমান্ড আছে। মানুষ দেখছে কোন অসুবিধা নেই। আমরা নাটক বানাচ্ছি ভাল। তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে টেভি নাটক না বানিয়ে তার বাইরে কিছু ব্যবসায়িক নাটক বানাচ্ছে। ওই জায়গায় সমস্যা। কারণ যারা অতি লাভের জন্য ওই কোয়ালিটিরি সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করছে, যার জন্য ভাল কিছু হচ্ছে না। যারা আমরা নিজেরা টেলিভিশনে বানাচ্ছি সেগুলো ভাল হচ্ছে। আমাদের ডিরেক্টর ও প্রডিউসার নিজে তত্ত্বাবধান করে নাটকগুলো বানায় যার জন্য আমাদের নাটকের মান ভাল হয়। লাগামহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে দর্শক বিমুখ হচ্ছে টিভি নাটকে, বললেন আরেক নাট্যকার মুহম্মদ মামুন অর রশীদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের টিভি নাটকে বিজ্ঞাপন বিরতি এত বেশি যে দর্শক অন্য চ্যানেলে চলে যায়। সে যদি আবার ফিরেও আসে, দেখে এখনও বিজ্ঞাপন চলছে, না হয় নাটক শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ নাটক দেখে না, এ কথা ঠিক না। আমার ‘চাটাম ঘর’ নামের একটি নাটক রিলিজ হয়েছে চার মাস আগে। প্রথম পর্বে ভিউজ আছে টু পয়েন্ট থ্রি মিলিয়ন। বলা যায় ২৩ লাখ ২৭ হাজার নয় শ’ পঞ্চাশ দর্শক নাটকটি দেখেছে। আমার ‘অলসপুর’ নাটকটি এক কোটিরও বেশি মানুষ দেখেছে। মানুষ যদি না দেখবে তাহলে টেন মিলিয়ন ভিউ হলো কিভাবে? এখনও ভাল গল্পের নাটক হচ্ছে। মনে রাখতে হবে টেলিভিশন নাটক একদিকে যেমন ব্যবসা অন্যদিকে একটি শিল্প। কোথাও মিস হলে সমস্যা হবে। ৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি নাটক তৈরি করা হলে, সেখানে যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ না হয় তো কেন নাটক বানাবে? টিভি চ্যানেলের প্রতি যেমন আমাদের চাপ আছে, তেমনি আমাদের প্রতিও চ্যানেলের চাপ আছে। এজেন্সি সম্পর্কে তিনি বলেন, ভাল নাটক হলে এজেন্সি লাগে না। হাত পাকানো নাট্যকারের হয়ত এজেন্সিতে যাওয়া লাগে। চাইলেই বাজেটের মধ্যে ভাল নাটক বানানো যায়। এ প্রসঙ্গে ডিরেক্টর গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলীক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে আমাদের নাটকের কন্টেন্টে একটু ঝামেলা হয়েছে। কোন স্টোরিকে কিভাবে প্রেজেন্ট করব এটাই সমস্যা। আমাদের আশপাশে অনেক চরিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক গল্প আছে আমাদের সামাজিক জীবনে। সেগুলিকে প্রেজেন্ট করার সুযোগ পাচ্ছি না বা করছি না। তার পেছনে অনেক কারণ। দেখা যাচ্ছে জীবনের সঙ্গে গল্পের অমিল খুঁজে পাওয়ার কারণেই দর্শক বিমুখ হচ্ছে। এখনকার নাটকের মধ্যে পরিবারপ্রথা নেই বললেই চলে। বাবা-মা, ভাই-বোনের ওপর কোন প্রেজেন্ট থাকছে না। আর টিভি নাটকে ধস নামার মূল ও প্রধান কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত বাজেট নেই। এত স্বল্প বাজেটের মধ্যে নাটক নির্মাণ করা খুব কঠিন। তার পরেও আমাদের নির্মাতারা নাটক বানাচ্ছে এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এভাবে তো আর কোন ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। নাটকের জন্য কোন একটা লোকেশন ঠিক করতে অর্থের প্রয়োজন, একটা আয়োজন দেখাতে গেলেও অর্থের প্রয়োজন হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এখন একজন নির্মাতা নাটক নির্মাণ করে তার পকেটে কোন পয়সাই আনতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে তো নাটকের মান উন্নয়ন করা মুশকিল। আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ক্যারেক্টার পাল্টানো উচিত। চ্যানেলে একটি ভাল নাটক চলতে চলতে প্রোমোশন কিন্তু নেই। সেটার কোন রিপিট নেই। আমরা পাশের দেশ ভারতের নাটকের তুলনা দিচ্ছি। তারা কিন্তু নাটককে প্রোমোট করছে। আমাদের দেশে সেগুলো মাথায় রাখছি না। সেখানে একটা এপিসোড যদি অন ইয়ার হয়, কমপক্ষে চারবার টেলিভিশনে দেখানো হয়। কোন না কোন ভাবে দর্শক সেটা দেখছে। সেখানে নাটকের ভেতরে আরেক নাটকের প্রমোশনাল যাচ্ছে। বিশেষ ভাবেই কিন্তু তারা প্রোমোট করার চেষ্টা চলছে। আমাদের এখানে টেলিভিশন দেখতে বসলে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় অস্থির হতে হয়। ৫ বা ৭ মিনিট নাটক দেখানোর পর কমপক্ষে ১০ মিনিট বিজ্ঞাপন চলে। দর্শকেরই বা দোষ কি? কিছু ভাল নাটক হচ্ছে, সেগুলো টেলিভিশনে না দেখলেও ইউটিউবে দেখছে। তার উপর আমরা জানি সে সব চাহিদাসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন তাদের রেমুনারাইজেশন বাজেটের তুলনায় আকাশ ছোঁয়া। ষাট পার্সেন্ট বাজেট নাটকের দুই-তিন আর্টিস্টের পেছনে চলে যাচ্ছে। বাকি চল্লিশ পার্সেন্ট দিয়ে নাটক নির্মাণ হচ্ছে। ডিরেক্টরের রেমুনারাইজেশন, স্ক্রিপ্ট পেমেন্ট, প্রডিউসারের প্রফিট, তারপর কস্টিউম, প্রডাকশনবয় থেকে শুরু করে এভরিথিং দিয়ে নাটক ভাল আশা করা যায় না। টেলিভিশনের ক্যারেক্টর তৈরি হওয়া উচিত। আমাদের দেশে চ্যানেলগুলোতে সবই অনইয়ার হচ্ছে। নাটক যাচ্ছে, নিউজ যাচ্ছে, স্পোর্টস যাচ্ছে। যখন একটা ভাল নাটক হচ্ছে তখন একটা টুর্নামেন্ট হলো। তখন ওই নাটক বাদ রেখে খেলা দেখানো শুরু হয়। কেন ওই নাটক দেখার জন্য দর্শক অপেক্ষা করবে? যখন নির্মাতারা নাটক নির্মাণ করে, তখন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রী পর্যন্ত সবাই মতামত দিতে পারে, কিন্তু চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা দুঃখজনক। গুটিকয়েক অভিনেতা অভিনেত্রী কাজ করছে কিন্তু অনেক গুণী শিল্পী কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। নির্মাতা চাইলেই দিতে পারছে না। পরিচালক মনে করছে এই চরিত্রের জন্য ‘এক্স’ কে নিলে ভাল হবে কিন্তু বাধ্য করা হচ্ছে ওয়াইকে নিতে। আমি মনে করি একজন লেখক, পরিচালক, প্রযোজক, টেলিভিশন চ্যানেল সবার মিলিত চেষ্টায় ভাল নাটক সম্ভব। এ নিয়ে আমরা ডিরেক্টর গিল্ডের পক্ষ থেকে সরকারকে কিছুদিন আগেও কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। নাট্যজন ড. ইনামুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রযুক্তির কারণেই দর্শক বাইরের নাটক দেখছে। তবে আমাদের দেশের নাটকগুলো বিষয়ের উপর তেমন কিছু চমকপ্রদ দিতে পারছে না। নাটক যে দর্শক একেবারে দেখছে না তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে এক খ-ের নাটক দেখে। আমি মনে করি, আমাদের টিভি চ্যানেল যারা চালাচ্ছে তাদেরও অনেকটা চয়েজি হতে হবে। যা ইচ্ছে তাই অনইয়ার করে দিলে বা ভাল জিনিস না দিলে দর্শক বিমুখ হয়ে যায়। যথেচ্ছ আঞ্চলিক ভাষা আমাদের নাটককে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারকেন্দ্রিক নাটক তেমন হচ্ছে না। কলকাতার নাটক কেন দেখে, ওখানকার বেশিরভাগ নাটকের ধারাবাহিকতা আছে। মোটামুটি সব ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি আছে। যেগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করা উচিত। আঞ্চলিকতা হয়ত অল্প বয়সীদের ভাল লাগতে পারে, কিন্তু ভাল নাটকের জন্য ভাল গল্প ও সংলাপের প্রয়োজন। নাটকের ক্ষেত্রে আমাদের ডিসিপ্লিনের অভাব। সবাই মিলে এর কারণগুলো সলভ করা প্রয়োজন। এ কথা সত্য যে নাটক হচ্ছে একটি সাহিত্য। সেই সাহিত্যকে আমরা ভুলতে বসেছি। নাটকে এখন শিল্পসত্তার অভাববোধ আছে, হয়তো পরিমিত বাজেট সঙ্কটও আছে, তা না হলে ভাল নির্মাতাদের নাটক আগের মতো টেলিভিশনে দেখতে পাওয়া যায় না কেন? ভাল নাটক নির্মাণের জন্য ভাল পৃষ্ঠপোষকতা জরুরী। এখন চ্যানেল অনেক, যোগ্যতর ব্যক্তিরাই সেখানে আছেন, আগেও যেমন ছিলেন। নাটক ভাল কি মন্দ হচ্ছে সেটা তাদের বিবেচ্য। বিজ্ঞাপন বিরতি কমিয়ে সত্যিকারের সাহিত্য নির্ভর নাটক দর্শককে উপহার দেয়া জরুরী। এদেশের টিভি নাটকের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, এখনই সময় তার ঘুরে দাঁড়ানোর। ভালমানের নাটক নির্মাণ ও প্রচারের মাধ্যমে আমাদের টিভি নাটকে আগের সেই গৌরব ফিরে আসুক এটাই কাম্য।
×