ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও কমছে না ব্যাংক ঋণের সুদের হার

প্রকাশিত: ১০:৩০, ৭ এপ্রিল ২০১৯

 প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও কমছে না ব্যাংক ঋণের সুদের হার

রহিম শেখ ॥ সুবিধা মিলেছে অনেক। কিন্তু কার্যত ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমছে না। বহু নির্দেশনা আর অসংখ্যবার বৈঠক করেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো যায়নি। এই সুদহার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার কথা বলেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন কমাতে। তারপরও কমেনি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিলি সব ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকের মালিক, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কয়েক বছর ধরে বার বার বৈঠক করলেও ফলাফল শূন্যই থেকেছে। এমনকি সব তফসিলি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তাও মানেনি কেউই। অল্পকিছু ব্যাংক কোন কোন গ্রাহকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে বলে জানা গেছে। বর্তমান সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক ঋণের সুদহার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর, ব্যাংকিং সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে ঋণ খেলাপীদের ৭ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধে সুবিধা দেয়ার কথা বলেছেন। যদিও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে মাসখানেক বাকি। ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১ মে থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। এর আগে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো নথির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত একটি ব্যাংকও সিঙ্গেল ডিজিট সুদে শিল্প ঋণ দেয়নি। যদিও দাবি করা হচ্ছে, ৯টি ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে শিল্প ঋণ বিতরণ করছে। বাস্তবে এসব ব্যাংকও ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদ আদায় করছে। এছাড়া নিজেদের আমানত বাড়াতে এবং রিপোর্ট ভাল দেখাতে আমানতের সুদ হারের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া রেট ৬ শতাংশ মানছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে ৮ বা ৯ কিংবা ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। ঋণের উচ্চ সুদের হার নিয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। একবার উদ্যোগ নিলাম সঙ্গে সঙ্গে কথাও বললাম। বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধাও করে দিলাম। যেমন আগে আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ অর্থ সরকারী ব্যাংকে আর ৩০ ভাগ বেসরকারী ব্যাংকে রাখা হতো। ব্যাংকের মালিকরা বললেন- এটা যদি ফিফটি ফিফটি করে দেয়া হয় তাহলে আমরা সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনব। সেটাও কিন্তু করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম এবং দিলাম। কিছু ব্যাংকে ঠিকই সুদের হার ৯ শতাংশে নামাল। কিন্তু সবাই তা করল না। বাড়াতে বাড়াতে ১৪, ১৫, ১৬-তে নিয়ে গেল। কেন করল না তাদের এ সুযোগটা দেয়া সত্ত্বেও ?’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আমার এখানে প্রশ্ন, এই ব্যাংকের মালিক যারা তাদেরও তো শিল্প-কলকারখানা আছে। তারাও তো ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এখন আমাকে তো সেই জায়গাটায় আগে হাত দিতে হবে। তারা ব্যাংকও চালাচ্ছেন, শিল্পও চালাচ্ছেন- আবার তারা সুদের হার কমাবেন না। তাহলে তাদের ব্যবসা কী কী আছে না আছে, ট্যাক্সটা ঠিকমতো দিচ্ছেন কিনা, ভ্যাট ঠিকমতো দিচ্ছেন কিনা, কাঁচামাল ঠিকমতো আছে কিনা- দেখতে হবে।’ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে রাজধানীর চকবাজারে ঘটে যাওয়ার অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতদের সহায়তায় অর্থ দেয়ার সময় সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ব্যাংক ঋণের সুদের হার বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বেসরকারী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানান, আমরা ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি সুদের হার কমানোর আশ্বাসও দিয়েছি প্রধানমন্ত্রীকে। জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে ঋণের সুদহার কমানোর কোন বিকল্প নেই। সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের কথা বললেও অধিকাংশ বেসরকারী ব্যাংক এখনও তা কার্যকর করেনি। উল্টো এখন সুদহার বাড়ছে। এ প্রবণতা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, শিল্পের মেয়াদী ঋণে অধিকাংশ ব্যাংক ১১ থেকে ১৬ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণে সুদ নেয়া হচ্ছে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। বাড়ি-গাড়ি কেনার ঋণে এখন ১১ থেকে ১৬ শতাংশ সুদ নেয়া হচ্ছে। ব্যবসা তথা ট্রেডিংয়ে সুদ দিতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। আর ক্রেডিট কার্ডে অধিকাংশ ব্যাংকের সুদহার রয়েছে ২৪ থেকে ২৭ শতাংশ। ঋণের সুদহারের উর্ধমুখী প্রবণতা ঠেকাতে গতবছরের এক নির্দেশনায় বছরে ১ শতাংশের বেশি সুদ না বাড়ানোর নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একবার বাড়ানোর জন্যও অন্তত তিন মাস আগে গ্রাহককে নোটিস দিতে বলা হয়। অপর এক নির্দেশনার মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ডে অন্য যে কোন ঋণের সর্বোচ্চ সুদের চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি সুদ না নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ নিচ্ছে। আর ব্যাংকগুলোর নিজেদের ঠিক করা ‘সিঙ্গেল ডিজিট’ তো মানাই হচ্ছে না। কিন্তু নানা সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ঋণ চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণে গতবছরের ৩০ জানুয়ারি ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন অনেক ব্যাংক ডাবল ডিজিট সুদে আমানত নিতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সুদহার কমানোর কথা বলে বিশেষ ছাড় পান ব্যাংক উদ্যোক্তারা। এছাড়া গতবছরের ১ এপ্রিল ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠক থেকে সিআরআর সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। সিআরআর কমানোর ফলে বিনা সুদে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাখার বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় পায় ব্যাংকগুলো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার ‘রেপো’ সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। এছাড়া সরকারী আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারী ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার আলোকে গতবছরের ২০ জুন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির বৈঠক থেকে জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয়া হয়। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ঘোষণার আলোকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকর করার অন্যতম শর্ত ছিল সরকারী প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে ব্যাংকে আমানত রাখবে। সরকারী ব্যাংকগুলোও উদ্বৃত্ত তহবিল বেসরকারী ব্যাংকে রাখার ক্ষেত্রে ৬ শতাংশের বেশি সুদ নেবে না। তবে কেউই তা মানছে না। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এখন আমানত নিতে ৯ শতাংশের বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। আবার ব্যাংকের মুনাফা বাড়ানোর জন্য ব্যাংকারদের ওপর চাপ রয়েছে। প্রবৃদ্ধি কমলে ব্যাংকারদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। এ ধরনের বাস্তবতায় সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকর সম্ভব নয়।
×