ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলের আট জেলায় তাপমাত্রা ওঠানামা করছে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

 উত্তরাঞ্চলের আট জেলায় তাপমাত্রা ওঠানামা  করছে

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে ॥ শীত মানেই নির্জীব প্রকৃতি। কুয়াশার শুভ্র আবরণ ভেদ করে মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় শীত প্রকৃতির সৌন্দর্যের উপস্থিতি। উত্তরবঙ্গের নীলফামারীসহ বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুরের আট জুড়ে শীতের সকালে সরিষার সবুজ গাছে শিশিরের ঝরনা ঝরছে। সাদা শিশিরে ভরা ক্ষেত। ভিন্ন মাত্রার কৃষি। ফাঁকে ফাঁকে সবজি লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বোরো বীজতলা। নদীর বুকে বা নদীর ধারে বোরো বীজতলাও প্রকৃতিকে সাজিয়ে দেয়। যা প্রকৃতির সার্বিক পরিবর্তন তার স্বাভাবিক নিয়মেরই পুনরাবৃত্তি। সহজভাবে বললে, প্রকৃতি তার স্বাভাবিকতাকে ধারণ করে এগিয়ে চলে। প্রকৃতির স্বাভাবিকতা মানুষকে স্বর্গসুখে নিমজ্জিত করে। এটি যেমন সত্য, ঠিক সমান বিপরীত আরেকটি সত্য হচ্ছে এই প্রকৃতির স্বাভাবিকতাই আবার কখনো কখনো অস্বাভাবিক ভয়ংকর, কাল হয়ে দাঁড়ায় মানুষের জন্য! ওই মানুষগুলো তারাই, যারা পেরে ওঠে না প্রকৃতির চিরাচরিত স্বাভাবিকতার সঙ্গে। যারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না প্রকৃতির পরিবর্তনজনিত আচরণের সঙ্গে। কারণ তারা প্রকৃতির স্বাভাবিকতার কাছে আর্থিক কারণে বড় দুর্বল! ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শীতকাল। বাংলা মাসের হিসেবে এটি হয় পৌষ-মাঘ দুই মাস। প্রতি বছর শীত মৌসুমে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সুবিধাবঞ্চিত মানুষজনের পোহাতে হয় শীতজনিত নানা রোগ-বালায় ও জটিলতা। বিশেষ করে হাজার হাজার মানুষ তীব্র শীতের প্রকোপে কাবু হয়ে পড়ে। পত্র-পত্রিকায় উঠে আসা সংবাদে শীতজনিত রোগে মারা যায় অনেক শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ। শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে দ্বগ্ধ হচ্ছে অনেকে। উত্তরাঞ্চলের রংপুর দিনাজপুর এলাকার আট জেলায় গত এক সপ্তাহ ধরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ হতে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। একদিকে প্রচন্ড শীত, অন্যদিকে কনকনে বাতাস শীতের তীব্রতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে হাজার হাজার সহায় সম্বলহীন হতদরিদ্র পরিবার। শীত বস্ত্রের অভাবে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন তারা। বিশেষ করে আগুন পোহানোর সময় অসাবধানতাবশত শাড়ির আঁচলে কিংবা কাপড়ে আগুন ধরে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গত তিন দিনে আগুন পোহানোর সময় ১৫ জন নারী ও শিশু অগ্নিদগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছে দুইজন। নিহতরা হলেন লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার রাজিয়া বেগম (২৭) এবং একই জেলার আদিতমারীর মোমেনা বেগম (৩২)। শুক্রবার সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী এলাকার অগ্নিদগ্ধ লাবণ্য বেগম জানান, তীব্র শীতের কবল থেকে বাঁচতে ধানের খড় দিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত পরনের ম্যাক্সির পেছনে আগুন লেগে যায়। এতে করে তার কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঝলসে গেছে। একই কথা জানালেন রংপুরের মমিনপুর গ্রামের এলাকার জরিনা বেগম। শীতের কারণে আগুন পোহানোর সময় কাপড় পুড়ে গিয়ে দগ্ধ হন তিনি। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মারুফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন শীতের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগুন পোহানোর সময় অগ্নিদগ্ধ হয়ে গত বছর ১২ জন মারা যান। এবার এ পর্যন্ত ১৫ জন অগ্নিদগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছে। রোগীদের বেশিরভাগেরই শরীরের নিচের অংশ ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। পাঁচ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ সরবরাহ না থাকায় রোগীদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। হতদরিদ্র রোগীর স্বজনরা প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে পারছেন না। তার পরেও চেষ্টা করে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের শীতের তীব্রতা সব সময় বেশি। হিমালয় থেকে আসা হিমেল হাওয়ায় জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। শ্রমজীবী মানুষ কাজে যেতেও পারে না। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় দরিদ্র, অসহায়, ছিন্নমূল ও দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে খড়খুটো জ্বালিয়ে শীত নির্বারণের চেষ্টা করছেন তারা। শীতের তীব্রতায় বিশেষ করে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, করতোয়া, মহানন্দা ও যমুনাসহ বিভিন্ন নদীবেষ্টিত চর ও গ্রামের বসবাসরত পরিবারগুলো রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন। হু-হু করে উত্তুরে বাতাস তাদের কাঁপিয়ে তুলছে। তিস্তা নদীর ডিমলা উপজেলার উত্তরখড়িবাড়ি এলাকার মোস্তাকিন (৪০) বললেন আমরা নদীতে নৌকা চালাই মাছ ধরি পাথর তুলি। কিন্তু কনকনে শীতে নদীতে নামাই যায় না। হাতে নগদ অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। ধার দেনা করে চলছি। একই এলাকার মজিদ মিয়া (৬০) বললেন প্রতি বছর শীতের সময় সরকারী ও বেসরকারীভাবে কম্বল বিতরণ করা হয়। কম্বলগুলোর মান এতো খারাপ যে যা চাদরের চেয়েও পাতলা। এক শীতের পর তা পরের শীতের ব্যবহার করা যায় না। কম্বলের মান ভাল ও মোটা হলে কয়েক বছরের শীত পার করা যায়। এদিকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। নীলফামারী সিভিল সার্জন ডাঃ রনজিৎ কুমার বর্মণ আধুনিক সদর হাসপাতালসহ জেলার প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে শীতজনিত ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ রোগের প্রকোপে রোগী বাড়ছে। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় এখনকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। শিশুদের বাসি খাবার পরিহার করা, পরিষ্কার ও ফোটানো পানি পান করানোর জন্য অভিভাবকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে তিনি এই শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের গরম রাখার জন্য পরিবারের সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
×