ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই ভোটযুদ্ধে নামবে সব দল

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই ভোটযুদ্ধে নামবে সব দল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশ কোন পথে যাবে? শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে, নাকি সাম্প্রদায়িক অন্ধকারাচ্ছন্ন উগ্র জঙ্গীবাদের পথে? জাতীয় জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ বাংলাদেশকে। সেই অগ্নিপরীক্ষার নির্বাচনের আর মাত্র ২৫ দিন বাকি। আগামী ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহার আর ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই জমে উঠবে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার। ছড়িয়ে পড়বে নির্বাচনী উত্তাপ। প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে নির্বাচনী ময়দানে নামবে দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলো। অর্থাৎ আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই সারাদেশে জমজমাট নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে। বহুল আলোচিত এই একাদশ জাতীয় নির্বাচনী ট্রেন যেন কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে- সেটি দেখতেই এখন অধীর আগ্রহে দিন গুনছে দেশের জনগণ। অনেক শঙ্কা-উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ৯০ পরবর্তী এই প্রথম ক্ষমতাসীন কোন রাজনৈতিক দলের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৯ বছর ধরে ‘দলীয় সরকার মানি না, মানবো না’ বলে দাবি আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রামের হুমকি দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত দেশের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনী মাঠে। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মেনে এবং তার সরকারের অধীনেই ভোটযুদ্ধে নেমে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সব সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোও। মনোনয়নপত্র দাখিল, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ। কিন্তু নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে অনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারছে না। তবে দেশের প্রধান দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন বড় দুই জোটের প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করে অনানুষ্ঠানিকভাবে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইতে শুরু করেছেন। দুই দলেরই অনেক নেতার বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের পর নির্বাচন কমিশনের কড়া হুঁশিয়ারির কারণে বড় দুই জোটের প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারে নামতে আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। মূলত পুরো নবেম্বর মাস থেকেই দেশের মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে নির্বাচনী জ্বরে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী নানা মহলের শঙ্কা, উদ্বেগ থাকলেও এখন সেটি আর নেই। একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দেশের ইতিহাসে নানা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। মাত্র তিন শ’ আসনের বিপরীতে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাসের রেকর্ড ভাঙ্গা প্রায় ১২ হাজার মনোনয়নপ্রত্যাশী এবার মনোনয়নের আবেদনপত্র সংগ্রহ করেছে। আর মনোনয়নপত্র বিক্রি বাবদ রেকর্ডসংখ্যক আয়ও করেছে এসব বড় দলগুলো। অপরদিকে তিন শ’ আসনের বিপরীতে ৮শ’ প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দিয়ে এককভাবে আরেকটি রেকর্ড গড়েছে বিএনপি। মনোনয়ন বাতিলের ক্ষেত্রেও রেকর্ড গড়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। একসঙ্গে বিভিন্ন দলের ৭৮৬ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের ঘটনা দেশের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। তবে এখনও জোটের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে এখন শেষ মুহূর্তে চলছে আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি। বড় দুই জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী কৌশলের কারণে কোন জোটই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেনি। আগামী ৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পরই উভয় জোট সংবাদ সম্মেলন করে নিজ নিজ জোটের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। সারাদেশেই নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লেও বিদ্রোহী প্রার্থিতা নিয়ে বড় দুই দলই রয়েছে সঙ্কটে। সেক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়ন যাচাই-বাছাই শেষে আওয়ামী লীগ দফতর সূত্রে জানা গেছে, দলের চূড়ান্ত মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও ২৭৪ জন নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক মনোনয়নবঞ্চিত নেতা (বিদ্রোহী) আগামী ৯ ডিসেম্বরই তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে অঙ্গীকার করেছেন। বাকি যেসব প্রার্থী রয়েছে তাদের বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত সব বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে বলেও দৃঢ় আশাবাদী দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তবে এবার দলের বিদ্রোহী প্রার্থী দমনে হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া বার্তা বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়া শুরু হয়েছে। জানা গেছে, দলীয় বা জোটের দেয়া প্রার্থীর বাইরে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের ফোন করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। আগামী ৯ ডিসেম্বরের আগেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এরপরও যদি কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এবার বিদ্রোহী প্রার্থী হলে শুধু দল থেকে আজীবন বহিষ্কারই নয়, ভবিষ্যতে কোনদিন বিদ্রোহীদের দলে ফিরিয়ে নেয়া হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত দু’জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশা প্রকাশ করে বলেছেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না। এক্ষেত্রে বেশ বিপাকেই রয়েছে দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জনকারী রাজনৈতিক দল বিএনপি। তিন শ’ আসনে দল ঘোষিত ৮শ’ নেতাকে এবার মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যাচাই বাছাই শেষে দল ঘোষিত প্রার্থীর বাইরে আরও প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ মনোনয়নবঞ্চিত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে। একদিকে ২০ দলীয় জোট এবং অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দীর্ঘ প্রার্থী তালিকা। আর নিজ দলের বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশীর চাপে জেরবার অবস্থা দলটির নীতিনির্ধারক নেতাদের। আনুষ্ঠানিক নির্বাচন প্রচার শুরুর আর এক সপ্তাহ বাকি। এখনও বিএনপি নিজ দল এবং জোটের একক প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি। জানা গেছে, তিন শ’ আসনের বিপরীতে এবার রেকর্ডসংখ্যক ৮শ’ প্রার্থীকে দলের মনোনয়নপত্র প্রদান করা হলেও যাচাই-বাছাই শেষে বিএনপির ৬ আসনে কোন প্রার্থীই নেই। দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তিন শ’ আসনেই বিএনপির একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। দলের চরম খারাপ অবস্থাতেও জেল-জুলুম ভোগ করেও এলাকায় থেকে কাজ করেছেন এমন অসংখ্য পোড়-খাওয়া নেতাই এবার বিএনপির মনোনয়ন পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কারণে উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতাদের কাছে আসন ছাড় দিতে হচ্ছে তাদের। অধিকাংশ আসনেই বিএনপির পোড়-খাওয়া নেতারা সহজে তা মেনে নিতে চাচ্ছেন না। এ কারণে তিন শ’ আসনের মধ্যে অধিকাংশ আসনেই এবার বিএনপি বিদ্রোহী প্রার্থী থেকে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। শুধু বিএনপি বা আওয়ামী লীগই নয়, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলেও অনেক আসনেই বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। জোটের আসন ভাগাভাগিতে সন্তুষ্ট হতে না পারা এসব প্রার্থীরা দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার হুমকি দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আগামী ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে আরও অনেক চমক অপেক্ষা করছে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শক্ত হাতে কত বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে সফল হবে তা দেখতে এই একটি সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। আর ৯ ডিসেম্বরের পরেই সারাদেশে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার, আনুষ্ঠানিক ভোটযুদ্ধ।
×