ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব

শেষ হলো সাত দেশের শিকড়ের সম্মিলন

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

শেষ হলো সাত দেশের শিকড়ের সম্মিলন

মনোয়ার হোসেন ॥ শিকড়ের সুরে সুরে কেটে গেল তিনটি রাত। শ্রোতারা মনভরে শুনলেন দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লোকসঙ্গীত শিল্পীদের গান। লোকগানের বাণীর মাঝে আবাহন করা হলো আপন সংস্কৃতি ও দর্শনকে। সেই সঙ্গে জানা হলো ভিন দেশের লোকগীতির ধারাকে। সময়ের হিসেবে প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা করে ১৮ ঘণ্টার সঙ্গীতাসরে এক আঙিনায় সমবেত হয়েছে শহরের নানা প্রান্তের মানুষ। ছয় প্রহরের সেই সঙ্গীতযজ্ঞ শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। রাজধানীর লক্ষাধিক সুররসিকের মন মজানো উৎসবটি শেষ হলো শনিবার। প্রাপ্তির বিবেচনায় দেশ-বিদেশের লোকজ সুরসুধায় উচ্চারিত হলো বাংলার লোকসঙ্গীতের নবজাগরণের প্রত্যাশা। অশুরের বিরুদ্ধে সুরের প্রতিবাদে স্বস্তির সুবাতাস ছড়িয়ে বিদায় নিল ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব। শেষ হলো সাত দেশের শেকড়সন্ধানী সুর সম্মিলিন। সমাপনী রাতে উৎসব আঙিনা বনানীর বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে ভেসে বেরিয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও স্পেনের লোকগীতির সুর। বাংলাদেশের নকশীকাঁথার সঙ্গে পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে ফোকব্যান্ড নকশীকাঁথা। স্পেনের নারী শিল্পীদের দল লাস মিগাসের মনমাতানো রাঙানো গানের সঙ্গে ভাললাগার অনুভব ছড়িয়েছে পাকিস্তানের শিল্পী শাফকাত আমান আলী। সমাপনী রাতে প্রথম পরিবেশনায় নিয়ে মঞ্চে আসে নকশীকাঁথা। বন্দনাগীতির আশ্রয়ে দলটি প্রথমে গেয়ে শোনায়Ñ এই দেশেরই মাটিতে সোনার ফসল ফলে। পরের গানটি ছিলÑ ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরারে/কোনদিন আসিবেন বন্ধু কইয়া যাও কইয়া যাওরে...। তৃতীয় গানে উঠে আসে মৈয়মসিংহ গীতিকার সুর। গীত হয়Ñ নয়া বাড়ি লইয়ারে বাইদা লাগাইলো বাইগুন/সেই বাইগুন তুলতে কইন্যা জুড়িল কাইন্দনরে/কাইন্দো না কাইন্দো না কন্যা না কান্দিও আর/সেই বাইগুন বেইচা দিমু তোমার গলার হার রে ...। এরপর গেয়ে শোনায়Ñ জবর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছো ঢেউ...। এভাবেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধারার ঐতিহ্যবাহী লোকগানগুলো শোনায় নকশীকাঁথা। কণ্ঠশিল্পী সাজেদ ফাতেমীর নেতৃত্বাধীন দলটিতে কাহন ও ঢোল বাজিয়েছেন বুলবুল। দোতারার সঙ্গে গিটারে সুর ছড়িয়েছেন সুমন। ফয়সালের বেইজ গিটারের সঙ্গে ছিল রোমেলের এ্যাকোর্ডিয়ান। কে কয় পিরিতি ভালা শিরোনামের গান দিয়ে পরিবেশনা শুরু করেন বাউল কবির শাহ্।বাউলসাধক শাহ্ আব্দুল করিমের এই শিষ্য পরিবেশিত পরের গানের শিরোনাম ছিলÑ কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে ফুলে পাইলা ভোমরা। লোকজ বাংলার পথে-প্রান্তরের সুর ধরে এই বাউল একে গেয়ে শোনায় ‘দুই চাক্কায় দৌড়ে গাড়ি কি আর করবি মন’, ‘নাতিন তুমি কাইন্দো না জামাই লন্ডনী’, ‘ভব সাগরের নাইয়া মিছা গরব করোরে পরার ধন লইয়া’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও’ ও ‘তোমার লাগি সাজাইয়াছি ফুলের বিছানা’। বৈঠকী আসরের বিচ্ছেদী ভাবের গান, ভাটিয়ালি আর মুর্শিদী গানের সৌরভ ছড়িয়েছেন এই শিল্পী। উৎসবের শেষ রাতের অন্যতম আকর্ষণ ছিল স্পেনের বার্সেলোনার ব্যান্ড লাস মিগাস। চার তরুণীর গড়া দলটি ফ্ল্যামেংকো আর সালসা ঘরানায় স্প্যানিশ ভাষায় গেয়েছেন আত্মার গান। দলটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন বেগো সালাযার। গিটারে সুর তুলেছেন মারতা রোবলস ও আলিশিয়া গ্রিলো। বেহালায় সুরসুধা ছড়িয়েছেন রসার লসকস। মূলত নিজস্ব ছন্দের অনুপ্রেরণা থেকেই লাস মিগাসের এগিয়ে চলা। চার শিল্পীর ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা, মতাদর্শ এক করে তৈরি করেন তাদের মিউজিক যা শ্রোতাকে নিয়ে যায় এক নস্টালজিক, ইউফোরিক যাত্রায়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত লাস মিগাসের সর্বশেষ অ্যালবাম ‘ভেন্তে কনমিগো’ ফ্লেমিংগো মিউজিক হিসেবে ১৮তম ল্যাটিন গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছিল। লাস মিগাস স্পেনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লোকজ ফেস্টিভালে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে সমাপনী রাতে সবশেষে মঞ্চে আসেন শায়ান চৌধুরী অর্ণব। সঙ্গীত পরিবারের সদস্য অর্ণব গেয়ে শোনান জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গান পরিবেশন করেন। অন্যদিকে আসরের সবশেষ পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পাকিস্তান সুফি গানের শিল্পী শাফকাত আমানাত আলী। পাকিস্তানের স্বনামধন্য ওস্তাদ আমানাত আলী খানের ছেলে শাফকাত সুফি ও পাকিস্তানের লোকজ সঙ্গীতের জন্য বিশ্বসঙ্গীত মহলে দারুণ সমাদৃত। তার গানের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ আসর। মেরিল নিবেদিত সান ফাউন্ডেশন আয়োিজত ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশসহ সাত দেশের ১৭৪ জন কণ্ঠ, যন্ত্রসঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পী।
×