ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এগারো বছরেও সন্ধান নেই সেই হারিছ চৌধুরীর

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ অক্টোবর ২০১৮

এগারো বছরেও সন্ধান নেই সেই হারিছ চৌধুরীর

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব, বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব দোর্দ- প্রতাপশালী হারিছ চৌধুরী পালিয়ে বেড়ানো এক রহস্যময় নিখোঁজ রাজনীতিক। বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খাওয়ার মতো দোর্দ- প্রতাপশালী এই রাজনীতিক সেই যে ওয়ান ইলেভেনের সময়ে প্রায় ১১ বছর আগে সপরিবারে দেশান্তরি হয়েছেন তারপর থেকে নিখোঁজ হয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে। দীর্ঘ ১১ বছর আগে সেই যে উধাও হয়েছেন তারপর থেকে তিনি কি দেশে আছেন নাকি বিদেশে আত্মগোপন করেছেন তা দলের কিংবা নিকটাত্মীয়, পাড়াপড়শীসহ কেউই তাকে দেখেছেন কিংবা কোন তথ্যচিত্র দিতে পেরেছেন হলফ করে বলতে পারেননি কেউই। বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় পলাতক ১৮ আসামির মধ্যে যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার পর আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি হারিছ চৌধুরী। কোন রাজনীতিকের এভাবে ঘৃণীত রহস্যময় নিখোঁজ থাকার ঘটনাটি রীতিমতো রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন। এ খবর দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী কোথায়, দলের কেউ জানে না! জানেন না আত্মীয়-স্বজনও। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে গোয়েন্দা সংস্থা। কোথায় তার অবস্থান তাও অজানা। এ বিষয়ে কোন স্পষ্ট তথ্য জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের ৪৭ বছরের শাসনামলের ইতিহাসে কলঙ্কের ঢোল গলায় নিয়ে তার মতো কেউ নিখোঁজ দেশান্তরি হয়নি। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় সাজাপ্রাপ্ত হারিছ চৌধুরী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকা-ের নেপথ্য নায়কদের অন্যতম। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের নানা কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে ওয়ান ইলেভেন আসতে না আসতেই ঢাকার গুলশানের আলিশান বাড়ি, দামী গাড়ি, শখের হরিণ, বিশাল সম্পত্তি সব ফেলে গ্রামের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ থেকে ওপারে ভারতের করিমগঞ্জে নানার বাড়ি পালিয়ে যান হারিছ চৌধুরী। ওয়ান ইলেভেনের ঝড়ে পতিত সবাই একে একে ঘরে ফিরলেও একজন ফিরেননি, হারিছ চৌধুরী তার নাম। করিমগঞ্জে গিয়েও প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সন্ধান চালিয়ে তার খোঁজ পায়নি। যারা মনে করতেন ভারত না হলে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এখন তারাও বলছেন, হারিছ চৌধুরী ওইসব দেশেও নেই। এমনকি বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সফরকালেও তার সন্ধান পাননি। সেখানকার দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন কোথায় হারিছ চৌধুরী? ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে বিএনপির সঙ্গেও তার যোগাযোগ নেই বলে জানান দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। প্রথম প্রথম সিলেটে প্রায়ই খবর রটে হারিছ চৌধুরী নাকি মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসা-যাওয়া করেন কিন্তু তার সত্যতাও মেলেনি। কিবরিয়া হত্যাকা-ের পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ওই হত্যার সঙ্গে হারিছ চৌধুরীর নাম নিয়ে সন্দেহের তীর ছুড়লে অনেকেরই চোখ কান খুলে যায়। তখন নানা মহলে হারিছ চৌধুরীর প্রতি কিবরিয়া হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ তীব্র হয়। কারণ তখন প্রভাবশালী এ রাজনৈতিক সচিবের নির্দেশেই হবিগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার বদলি, হত্যা তদন্তের পুলিশী কর্মকর্তা রদবদলের ঘটনা ঘটে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে এই হারিছ চৌধুরীই দেশের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসন ছিল তারই হুকুমের দাস। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কাঁধে বন্দুক রেখে নানা অপরাধ সংঘটিত করার নেপথ্য নায়কও নাকি ছিলেন এই হারিছ চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী জানেন, তার পাপের বোঝা কতটা ভারি। প্রতিমন্ত্রী বাবরের রিমান্ড ও জেলজীবন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় দেশে ফিরলে কী হতে পারে তার করুণ পরিণতি। তাই তার দল ও দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিএনপি জমানায় দাপটের সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করা এই মানুষটি পৃথিবীর যেখানেই আছেন আঁধারেই লুকিয়ে রয়েছেন। তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি নিশ্চিত করেছে একুশ আগস্ট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হানিসাকে হত্যার উদ্দেশে যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয় তার নেপথ্যের হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমানের দক্ষিণহস্ত ছিলেন হারিছ চৌধুরী। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান জকিগঞ্জ সফরকালে বেসরকারী কলেজের শিক্ষক হারিছ চৌধুরীকে তার বক্তৃতা শুনে দলে টানেন। ঢাকায় এসে যুবদল করে নানা তদবির, ফন্দি-ফিকিরে শুরু হয় তার নতুন জীবন। এরশাদ জমানায় শাহজাহানপুরে ছোট্ট দ্বিতলের ফার্নিচারের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে বিজয়নগরে আশা কারভিশন নামে গাড়ির শোরুম খোলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক সাবেক চেযারম্যানের ভাই ছিলেন পার্টনার। ওই সময় এক ব্যাংক কর্মকর্তার বদলির তদবিরে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছে নাজেহাল হন। ’৯১ সালের নির্বাচনে তার গ্রামের বাড়ি জকিগঞ্জ আসনে ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হয়েই জামানত হারান। এরশাদের বন্যার সময় তার শরীরে ভয়াবহ চর্মরোগ দেখা দিলে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে চিকিৎসা সঙ্কটে পড়েন। সে সময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস পয়সা কড়ি দিয়ে তার চিকিৎসা করান। ২০০১ সালে নির্বাচনের সময় তিনি বিএনপির হাওয়া ভবনের মন জয় করেন। নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে হারিছ চৌধুরীর নতুন চেহারায় আবির্ভাব ঘটে রাজনৈতিক সচিব হিসেবে। তখন মন্ত্রীরা তো বটেই, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও তার মন জুগিয়ে চলতে তটস্থ থাকতেন। রাতারাতি বিত্ত বৈভবের জৌলুসপূর্ণ জীবনের অধিকারী হন হারিছ চৌধুরী। দেশে বিশাল সম্পদের বাইরে তার লুটপাটের টাকায় যুক্তরাজ্য বিএনপির রিক্ত নিঃস্ব এক নেতার নামেই পাঁচটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালু করান। কিনেন মূল্যবান বাড়ি। ওয়ান ইলেভেনের বিপর্যয় কেটে যাওয়ার পর কী নির্বাচন, কী দলীয় কাউন্সিল কোন কিছুরই খবর নেননি হারিছ চৌধুরী। তাই বিএনপির কমিটি থেকেও কাউন্সিলে মুছে যায় হারিছ চৌধুরীর নাম। জানা যায়, বিএনপি হাইকমান্ডও এই বিতর্কিত মানুষটির দায় নিতে নারাজ। সেই যে ওয়ান ইলেভেনের সময়ে দেশান্তরি হয়েছেন তার পর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জমানায় যেই ধরনের কুকর্ম করেছেন, দেশে ফিরলে কি করুণ পরিণতি হতে পারে তা স্মরণ করেই লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে রহস্যময় নিখোঁজ হওয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছেন হারিছ চৌধুরী।
×