ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেড় শ’ বছর আগের ইতিহাস, নতুন রূপে সামনে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১১ অক্টোবর ২০১৮

দেড় শ’ বছর আগের ইতিহাস, নতুন রূপে সামনে

মোরসালিন মিজান ॥ নিমতলী দেউড়ির নতুন রূপ দেখে, বলে বোঝানো যাবে না, কতটা অভিভূত হয়েছি। দেড় শ’ বছর আগের স্থাপনা। ঢাকার নায়েব নাজিমদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। বারবারই কৌতূহল নিয়ে দেখা হয়েছে। তবে এখন যোগ হয়েছে বাড়তি বৈশিষ্ট্য। সংরক্ষণের পাশাপাশি তোরণটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি জাদুঘর। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে। ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’ নামে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সোসাইটির নতুন দুই ভবনের মাঝখানে অবস্থিত তোরণ এখন আলোকোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। পুরো কাজের কী ভাল, কী মন্দ, তা চট করে বলা যাবে না। পরিবর্তন দেখে চমকিত হয়েছি। হতে হয়েছে। ইতিহাস অনুসন্ধানে যাদের মন, তারাও সমৃদ্ধ হবেন। মুগ্ধ হবেন দর্শনার্থীরা। আজ বৃহস্পতিবার জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বসাধারণের জন্য প্রবেশদ্বার খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। ইতিহাসটি অনেকেরই জানা। আজ যেখানে নিমতলী গেট, তার আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। নবাব জসরত খানের বসবাসের জন্য ১৭৬৫-৬৬ সালের দিকে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। তত্ত্বাবধানে ছিলেন ঢাকার প্রথম ব্রিটিশ সামরিক শাসক ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টন। জসরত খানের পর তার উত্তরাধিকারীরা প্রাসাদে বসবাস করেন। নবাব হাসনাত জং ও নবাব নূসরত জং ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এখানে ছিলেন। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বিপুল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল এই প্রাসাদ। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল ও এর আশপাশের এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল একাধিক ভবন। কিন্তু ১৮৯৭ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রাসাদসহ অধিকাংশ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। অক্ষত ছিল একাধিক প্রবেশদ্বার বা তোরণ। একটি প্রবেশদ্বার এখনও স্মৃতির জানালা হয়ে আছে। এটিই বর্তমানে নিমতলী দেউড়ি বা নিমতলী গেট নামে পরিচিত। জানা যায়, এশিয়াটিক সোসাইটি ২০১০-১১ সালে দেউড়ির প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে। তখনই এখানে স্থায়ী জাদুঘর গড়ার পরিকল্পনা হয়। ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয় বাস্তবায়নের কাজ। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি জাদুঘর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আজ বৃহস্পতিবার জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার আগের দিন বুধবার নিমতলীতে গিয়ে দেখা যায়, সদ্য রং করা দেউড়ি। প্রকৃত রংটি ছিল সাদা। কিন্তু সংরক্ষণের সুবিধার্তে পোড়া ইটের রং ব্যবহার করা হয়েছে। তোরণটি ত্রিতল এবং বহুভুজ বিশিষ্ট ইমারতের মতো দেখতে। নির্মাণে কাঠ, লোহা, ইট, সুরকি ও পাথরের বিশেষ ব্যবহার লক্ষণীয়। মুঘলদের নির্মাণশৈলী। পাশ্চাত্যের প্রভাবটাও স্পষ্ট। দুটোর সমন্বয়ে অনন্য সাধারণ স্থাপনা। তোরণের মাঝখানে ৫ মিটার প্রশস্ত পথ। পথের একেবারে শুরুতে হাতের ডান পাশে একটি কক্ষ। কক্ষটিকে জাদুঘরের ১ নম্বর গ্যালারি হিসেবে সাজানো হয়েছে। পরিপাটি করে সাজানো গ্যালারিতে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। আদ্যপান্ত। সুদৃশ্য দেয়ালে সোসাইটির প্রথম সভাপতি ও প্রথম সাধারণ সম্পাদকের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। সংলগ্ন কক্ষটি ২ নম্বর গ্যালারি। এখানে নিতমলী গেট সংস্কার ও সংরক্ষণের সচিত্র বর্ণনা। ১৮৬৩ সাল, ১৮৭৪ সাল ও ১৯৫০ সালের সংস্কার কাজ দৃশ্যমান করা হয়েছে। আছে একেবারে সাম্প্রতিক কালের ছবিও। নিচ তলার বাম পাশের কক্ষটি ৩ নম্বর গ্যালারি। এখান থেকে নায়েব নাজিমদের ইতিহাস বলা শুরু। আলোকচিত্র ও নথিপত্রের মাধ্যমে ঢাকার নায়েব নাজিমদের পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে। একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলে সরু প্যাঁচানো সিঁড়ি। সিঁড়ি ধরে দ্বিতীয় তলায় পৌঁছলে একমাত্র কক্ষটি। জাদুঘরের এটি চার নম্বর গ্যালারি। এখানে নায়েব নাজিমদের প্রতিকৃতি। তাদের শাসনকালের বিস্তারিত বাংলায় ও ইংরেজীতে তুলে ধরা হয়েছে। দেউড়ির সবচেয়ে বড় কক্ষটি তৃতীয় তলায়। এটি পাঁচ নম্বর গ্যালারি। ৬০০ স্কয়ার ফিট জায়গায় ‘আর্ট এ্যান্ড লাইফ অব ঢাকা’ দৃশ্যমান করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। কয়েকটি গ্লাস শোকেসে ঐতিহাসিক নিদর্শন। পোশাক, চীনামাটির পাত্র, গহনার বাক্স, পানপাত্র ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর সাজানো। আছে মুদ্রাসহ আরও কিছু অমূল্য নিদর্শন। ফ্লোর প্যানেলে দুর্লভ আলোকচিত্র। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে ডিওরামাটি। এই গ্যালারিতে নবাব নূসরত জংয়ের ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনা। প্ল্যাস্টার অব প্যারিস মাধ্যমে গড়া নূসরত জং যেন জীবন্ত। যেন বাস্তবেই বসে আছেন। তাকে বড় পাখা দিয়ে বাতাস করছেন একজন। অন্যজন তলোয়ারসমেত। নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত। দেখে সময়টাকে ফিল করা যায়। অতীতের সুর যেন বাজে। সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও একাডেমিক প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে জাদুঘর বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নায়েব নাজিমদের প্রায় দেড় শ’ বছরের শাসন ঢাকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেবে জাদুঘর। একে একটি শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। জাদুঘরটি হবে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র। এটিকে শিক্ষা ও বহুমুখী গবেষক এবং পর্যটকদের জন্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সাধারণ ঐতিহ্য প্রিয়াসী নাগরিক, দর্শক, ঢাকা প্রেমিক, গবেষক ও ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরা এই জাদুঘরের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। জাদুঘরের রিসার্চার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সব ঠিক থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জাদুঘরটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। একসঙ্গে ১০ থেকে ১৫ জন জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
×