ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বালু উত্তোলনে বিপর্যয়ে বগুড়া অঞ্চল

প্রকৃতির সাজানো স্তর তছনছ

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রকৃতির সাজানো স্তর তছনছ

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার মাটির নিচে শিলা,বালি ও পানির সাজানো স্তর কতটা ঠিক আছে তা ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। ভূবিজ্ঞানীগণ বলছে, বগুড়া ভূকম্পন প্রবণ এলাকার বড় একটি জোনের মধ্যে পড়েছে। এই জোনকে আরও এগিয়ে নিয়েছে বগুড়ার মাটির উপরিভাগে এবং নদীর মধ্যে উচ্চ ক্ষমতার ইঞ্জিন বালির উত্তোলন। বালি উত্তোলনের সময় প্রথমে পানি উঠে আসে। এ সময় প্রকৃতির তৈরি ভ-ূঅভ্যন্তরের সাজানো কাঠামো ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। মাটির নিচে সৃষ্টি হয় ভ্যাকিউম (ফাঁপা)। এ অবস্থান কখনও ভ-ূউপরিভাগের মাটি দেবে যায়। কখনও নদীর তলদেশে বিপর্যস্ত হয়ে বিকট শব্দে ধসের সৃষ্টি হয়। এভাবে মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বগুড়া ও আশেপাশের অঞ্চল। অশুভ এই থাবা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বগুড়া সদরের কয়েকটি এলাকা, করতোয়া নদীর ভেতরে, ধুনট ও সারিয়াকান্দি এলাকায় যমুনার ভেতরে, কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি এলাকা মাটির উপরিভাগে উচ্চশক্তির ইঞ্জিনের সঙ্গে বেশি ব্যাসার্ধের পাইপ ড্রিলিং করে মাটির নিচে বসিয়ে অধিক চাপে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। এই বালি বিক্রি হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণ কাজে। এমনও দেখা গেছে যে স্থানে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে তার অল্প দূরেই ইঞ্জিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করা হয়। দত্তবাড়ি, গোকুল, কালিবালা, ঠেঙ্গামারা, তেলিহারা শেখেরকোলা এলাকায় বালি উত্তোলন করার পর ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় অবকাঠামো নির্মাণন স্থলে। ওই এলাকায় অবৈধ বালিমহাল গড়ে উঠেছে। বগুড়া সদরের মানিকচক এলাকায় কয়েক ব্যক্তি প্রথমে বালি উত্তোলন করার পর মাটি দেবে গেলে সেখানে পুকুর বানিয়ে মাছের চাষ করছে। বালি উত্তোলনের পর আশেপাশের এলাকা দেবে ও ধসে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে ওই এলাকায় অন্তত দুই শ’ বিঘা ভূমি দেবে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর, জমিজিরাত ধসে গেছে। এদিকে নদীর ভেতরে বিশেষ ব্যবস্থায় উচ্চশক্তির শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে নদীর ড্রেজিং হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, নদীর বেড লেভেল বা তলদেশের কাঠামো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। নদীর তীরের বালি উত্তোলন শেষ হয়ে গেলে নৌকা করে ভেতরে গিয়ে ড্রাম সেটিং পদ্ধতিতে শ্যালো ইঞ্জিন বসানো হয়। তারপর বেশি ব্যাসার্ধের পাইপ ড্রিলিং করে তলদেশের গভীরে যতটা পারা যায় প্রবেশ করিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে টেনে আনা হয়। উত্তোলিত বালি প্রথমে নৌকায় পারাপার করে পরে বালিমহালে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার নদীর ভেতরে পাইপ নিয়ে যেতে গ্যাস পাইপের মতো প্লাস্টিকের পাইপ পানির ওপর দিয়ে ভাসিয়ে ভেতরে নেয়া হয়। পুরো বিষয়টি প্রকৌশল প্রযুক্তির মতো। যা সাধারণ মানুষেই করে। নীরবে এমন বিপর্যয় ঘটছে চোখের সামেনই। ঘটনাগুলো এলাকার লোক জানে। প্রশাসন এই বিপর্যয় বন্ধে মাঝে মধ্যেই বালি উত্তোলনের ইঞ্জিন,পাইপ জব্দ করে নেয়। কখনও যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দেয়। তারপর প্রভাবশালী একটি শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যায়। বালি উত্তোলনকারীরা এতটাই বেপরোয়া যে কোন্ এলাকার বালি কে তুলবে এমন আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- চলে। মাঝে মধ্যেই বালি উত্তোলনকারীদের মধ্যে বিরোধের জের ধরে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এমন বিরোধে গত দুই বছরে বগুড়ায় ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। গত শতকের ৯০’র দশকের শুরুতে যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করে বালি উত্তালনের পালা শুরু হয় বগুড়ায়। পরে তা জয়পুরহাট, নওগাঁ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। মাটির তলদেশে কতটা ভ্যাকুয়ামের সৃষ্টি হয়েছে তা পরীক্ষা করা হয়নি। খালি চোখেই দেখা যায় বগুড়ার পূর্ব ও পশ্চিমাংশের অনেক এলাকা কিছুটা দেবে গেছে। বগুড়া অঞ্চলের কয়েক ব্যক্তি বললেন, বালি উত্তোলনকারীরা এতটাই ধুরন্ধর যে এক সেট আটক হলে ও পুড়িয়ে দিলে আরেক সেট দিয়ে কাজ শুরু করে দেয়।
×