ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

পাকি যোগসূত্র স্পষ্ট

পাকিস্তানী আর্জেস গ্রেনেড দিয়েই হয় একুশে আগস্ট হামলা

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 পাকিস্তানী আর্জেস গ্রেনেড দিয়েই হয় একুশে  আগস্ট হামলা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পাকিস্তানী আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে হামলা চালানো হয়েছিল। যা গ্রেনেড হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র থাকার বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। সারা বিশ্বে শুধুমাত্র অস্ট্রিয়া ও পাকিস্তানে আর্জেস গ্রেনেড তৈরি হয়ে থাকে। তাও আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে। ফলে এসব গ্রেনেড কোন দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাড়া বাইরের কারও কাছে থাকার কথা নয়। কয়েক দফা হত্যাচেষ্টার পরেও বেঁচে যাওয়ার কারণে নিশ্চিতভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই পাকিস্তান থেকেই আর্জেস গ্রেনেডগুলো আনা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড চট্টগ্রামে জড়ো করে সেগুলো পরে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আব্দুল সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাইজুদ্দিনের কাছে পৌঁছে দেয় পাকিস্তানী জঙ্গী আবু ইউসুফ বাট ওরফে আব্দুল মাজেট বাট ওরফে আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ বাট। তাইজুদ্দিন কিছু গ্রেনেড নিজের কাছে রেখে বাকিগুলো হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে দেয়। মুফতি হান্নান সেগুলো বাড্ডা থেকে হামলাকারী জঙ্গীদের কাছে দেয়। জঙ্গীরা গ্রেনেড নিয়ে বাসে করে সমাবেশের কাছাকাছি গিয়ে বিভিন্ন ভবনের ছাদে ওঠে হামলা চালায়। সিআইডি সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়। আহত হয় পাঁচ শতাধিক। ঘটনাস্থলে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত ছিল। সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ত। এ ঘটনায় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তনকারীদের অন্যতম আফগান ফেরত যোদ্ধা হুজির আমির মাওলানা এসকে আব্দুস সালামকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি জানান, ২০০৪ সালের মার্চের প্রথম দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদের ভেতরে প্রথম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় তিনি ছাড়াও মুফতি হান্নান ও পাকিস্তানী নাগরিক মজিদ এবং তাইজুদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই প্রথম বলা হয়, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারতীয় মুজাহিদীনদের কর্মকা- চালাতে খুবই অসুবিধা হয়। তাই আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে হবে। তাইজুদ্দিন জানায়, এ কাজে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের সহযোগিতা করবে। কোন অসুবিধা হবে না। শুরু হয় হামলার প্রক্রিয়া। তিনি এরপর পাকিস্তান যান। হামলা চালানোর জন্য গ্রেনেড এনে চট্টগ্রামে জড়ো করে মজিদ বাট। সেগুলো পরে এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই হুজি নেতা তাইজুদ্দিনের কাছে দেয় মজিদ বাট। তাইজুদ্দিন কিছু গ্রেনেড নিজের কাছে রাখে। বাকিগুলো মুফতি হান্নানের কাছে দেয়। মুফতি হান্নান কিছু গ্রেনেড ভারতের কাশ্মীরি মুজাহিদদের কাছে পাঠায়। মুফতি হান্নান কিছু গ্রেনেড নিজের কাছে রেখে দেয়। সেই গ্রেনেডগুলো দিয়েই একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সিআইডি সূত্র বলছে, ২০০৭ সালের জুনে ইউসুফ বাট গ্রেফতার হওয়ার পরেও এমন তথ্য জানায় জিজ্ঞাসাবাদে। ইউসুফ ভাট জন্মসূত্রে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ইসলামাবাদ জেলার কুলগাঁওয়ের তেরিগাঁও এলাকার বাসিন্দা। পিতার নাম আব্দুর রহমান বাট। চার ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা শেষে ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সরকারী ডিগ্রী কলেজ থেকে বায়োলজিতে অনার্স করে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ছাড়ার পর পাকিস্তানের নাগরিকত্ব পায় সে। পাকিস্তান জামায়াতের সামরিক শাখা হিজবুল মুজাহিদিনের শীর্ষ পর্যায়ের সংগঠকের দায়িত্ব পায় মজিদ বাট। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মদদে ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় হিজবুল মুজাহিদিন। ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউসুফ বাট আদালতে ১৪ পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তাতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সক্রিয় জঙ্গীদের বিষয়ে বহু তথ্য রয়েছে। তাইজুদ্দিন তাকে জোহরের নামাজের সময় সাত মসজিদে নিয়ে যায়। সেখানে সে মাওলানা আব্দুস সালাম ও মুফতি হান্নানকে পায়। সেখানেই প্রথম আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে আলোচনা হয়। জবানবন্দীতে ইউসুফ ভাট আরও জানায়, ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা, ওই বছরের ২১ জুন সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ৭ আগস্ট সিলেটে তৎকালীন মেয়র বদরুদ্দিন আহমেদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যায় ব্যবহার হওয়া গ্রেনেডগুলো পাকিস্তানের তৈরি। সেগুলো পাকিস্তান থেকে এসেছে। পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে গ্রেনেডগুলো চট্টগ্রামে আনা হয়। পরে সেগুলো তাইজুদ্দিনের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। মজিদ বাটের স্ত্রী সিরাজগঞ্জের ধানবান্দির বাসিন্দা কাঁকনও বিবিও আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে এমন তথ্য জানিয়েছে। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন তেহরিক-ই-জিহাদি ইসলামী (টিজেআই) নেতা মুজাফফর শাহ গ্রেনেডগুলো বাংলাদেশে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করে। হুজির সঙ্গে হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক-ই-জিহাদি ইসলামী-টিজেআই, লস্কর-ই-তৈয়বা, জয়েশ-ই-মোহাম্মদ, হরকাতুল মুজাহিদিন, আল বদর, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর মতো পাকিস্তানী ও আফগানিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশের হুজিসহ অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ২০০০ সালে মজিদ বাট পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ২০০২ সালে সে ঢাকায় বসবাস শুরু করে। পরে তাকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করে দেয় এদেশীয় জঙ্গীরা। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার বানিয়াচালা মেম্বার বাড়ি মসজিদের মেহমান খানা থেকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাকে জিজ্ঞাসাবাদেও বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মুফতি হান্নান কিছু গ্রেনেড বাড্ডায় নিজের বাড়িতে মজুদ করে রাখে। সেই গ্রেনেড ২১ আগস্ট হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের কাছে দেয়। জঙ্গীরা গ্রেনেড নিয়ে পাবলিক বাসে করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যায়। সেখানে বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে হামলা চালায়। হামলার ভয়াবহতায় জঙ্গীরা তাদের কাছে থাকা গ্রেনেডগুলো তাড়াহুড়া করে ছুড়ে মারে। তাড়াহুড়ার কারণে বেশ কয়েকটি গ্রেনেডের সেফটি পিন না খুলেই ছুড়ে মারে। যা অবিস্ফোরিত অবস্থায় পরে উদ্ধার হয়। আলামত হিসেবে উদ্ধার হওয়া সে সব গ্রেনেড বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সার্বিক মনিটরিংয়ে ধ্বংস করা হয়। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, পৃথিবীতে প্রথম আর্জেস গ্রেনেড উৎপাদন করে অস্ট্রিয়া। এজন্য অস্ট্রিয়ার নামের প্রথম অক্ষর ‘এ’ অনুসারে গ্রেনেডের নাম রাখা হয় আর্জেস। পরবর্তীতে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক তৈরিকারক দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠনের অনুমতি সাপেক্ষে আর্জেস গ্রেনেড উৎপাদন করার অনুমতি পায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের তৈরি গ্রেনেডগুলোও আর্জেস গ্রেনেড হিসেবে পরিচিত। সেগুলোর পার্থক্য করার জন্য পাকিস্তানের তৈরি গ্রেনেডগুলোর গায়ে পি (পাকিস্তান) লেখা থাকতে হবে। পাশাপাশি গ্রেনেডগুলোর সব হবে ৮৪ মডেলের। গ্রেনেড হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো আর্জেস-৮৪ মডেলের। যা পাকিস্তানের তৈরি। এসব গ্রেনেড একমাত্র পাকিস্তান সরকারই তৈরি ও ব্যবহার করতে পারবে বলেও বাধ্যবাধকতা আছে। সে মোতাবেক গ্রেনেডগুলো রাষ্ট্রীয় অস্ত্র বিক্রি চুক্তি ব্যতিত কোন রাষ্ট্রের কাছেই যাওয়ার কথা নয়। আর ব্যক্তিগত বা কোন সংগঠনের কাছে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এজন্য ধারণা করা হচ্ছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় পাকিস্তানের কোন না কোনভাবে জড়িত। র‌্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শতাধিক আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো পাকিস্তানের তৈরি। তারমধ্যে ২০০৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব-৩ ঢাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৪টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে। ২০০৭ সালের ২৮ ও ২৯ অক্টোবর র‌্যাব রাজধানীর বাড্ডা থেকে হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ১৬টি আর্জেস গ্রেনেড ও চারটি একে-৪৭ রাইফেল, বিপুল পরিমাণ তাজা বুলেট, শক্তিশালী বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেফতার করে। আর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালের দেয়া তথ্য মোতাবেক ২০০৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা নজরুল ইসলাম ঘরামীর কাছে থাকা ৪১টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে। ২০০৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব-২ একটি আর্জেস গ্রেনেড, র‌্যাব-১২ ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে ১টি এবং র‌্যাব-১ এবং র‌্যাব-৯ যৌথ অভিযান চালিয়ে ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি থেকে ১০টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে অবিস্ফোরিত অবস্থায় একটি ও হামলার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আরও একটি আর্জেস-৮৪ মডেলের গ্রেনেড উদ্ধার হয়। সবমিলিয়ে ৭৫টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার হয়। সবকটিই আর্জেস-৮৪ মডেলের গ্রেনেড। সিআইডি জান্দালের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, একুশে আগস্ট হামলায় যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে, সেই একই চালানের গ্রেনেড নজরুল ইসলাম ঘরামীর কাছে রাখা হয়েছিল। গ্রেনেডগুলো ভারতীয় মুজাহিদিনদের কাছে পৌঁছাতে সাতক্ষীরায় ঘরামীর বাড়িতে রাখা হয়েছিল। সেগুলোর পাঠানোর দায়িত্বও ছিল নজরুল ইসলাম ঘরামীর। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, উদ্ধারকৃত আর্জেস গ্রেনেডগুলো পাকিস্তানের তৈরি এইচই (হাই এক্সপ্লোসিভ) ৮৪ মডেলের।
×