ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ঘটনা রোধে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের তাগিদ

মহাসড়কে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ যানবাহন ॥ শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ আগস্ট ২০১৮

মহাসড়কে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ যানবাহন ॥ শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হচ্ছে সরকার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সাবধান। মহাসড়কে চলছে অটোরিক্সা, হিউম্যান হলার, নসিমন, করিমনসহ সব ধরনের নিষিদ্ধ যানবাহন। অথচ প্রায় তিন বছর আগে দেশের ২২টি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার এ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। ফলে এবারের ঈদের আগে ও পরে বড় বড় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এসব পরিবহন। পরিস্থিতি বিবেচনায় টনক নড়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উপদেষ্টা পরিষদের নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর হচ্ছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনস্বার্থে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার বড় মাধ্যম হলো অঙ্গীকার বাস্তবায়ন। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এবারের ঈদে ঢাকা-চট্টগ্রাম-নাটোর-সিলেট মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে বড় প্রায় সবকটি সড়ক দুর্ঘটনা এ তিনটি মহাসড়কেই ঘটেছে। সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার মন্ত্রণালয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের আগে পরে যে কটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে এর কয়েকটি আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে। ঈদকে কেন্দ্র করে মহাসড়কে এই শিথিলতা দেখা দেয়। এই সুযোগ নিয়ে মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন চলতে শুরু করেছে। ফোর লেন সড়কে উল্টো পথে গাড়ি আসায় দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমরা এসব বিষকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছি। মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন কোন ভাবেই চলতে দেয়া যাবে না। ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি কমিটিও গঠন করে দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নিষিদ্ধ যানবাহন সড়কে না চললে এবার দুর্ঘটনা অনেক কম হতো। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২২ মহাসড়কে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ অযান্ত্রিক ও স্বল্প গতির যানবাহন প্রায় তিন বছর আগে নিষিদ্ধ করে সরকার। এ সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। অর্থাৎ সরকারী সিদ্ধান্ত যে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনাগুলো তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দিল। সিদ্ধান্ত যথাযথ কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সোমবার সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চলাচল করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ২২ মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন যেন ফের চলাচল করতে না পারে সে বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো কেন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে ছোট বড় অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও সবগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টরের মালিক ও শ্রমিক নেতারা সরকারের অংশীদার। তারা যদি প্রকৃতপক্ষে সরকারকে সহযোগিতা করতে চায় তাহলে জনস্বার্থে নিষিদ্ধ যানবাহন মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করতে পারে। কিন্তু দেখা যায় তারা সহযোগিতার বিপরীতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, মালিক ও শ্রমিক নেতাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে দিয়ে বলাতে বাধ্য করেছেন সামনে নির্বাচন, তাই এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ করা যাবে না। এই যদি হয় বাস্তবতা, আমরা বলব তাহলে সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখে মুখেই। তিনি বলেন, নির্বাচনের বছর হলেও জনস্বার্থের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা মনে করি দেশবাসীকে দেয়া অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে জনগণের আরও কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। এতে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে। এদিকে মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইতোমধ্যে মহাসড়কে ৮০ ভাগ স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল কমেছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটানোর। তবে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে বলে জানান তিনি। সিআইপিআরবি’র জরিপ ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) সম্প্রতি একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় এবং তার জের ধরে পরে মৃত্যুবরণ, এমন মানুষের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ৬৪ জন। ২০১৬ সালে এর মোট সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৬৬ জন। এর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনায় অন দ্য স্পট মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বুয়েটের এ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই), প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২৩ বছরে মোট ৮৪ হাজার ৪৩৫টি দুর্ঘটনায় অন দ্য স্পট মৃত্যু হয়েছে ৬৪ হাজার ১১২ জন মানুষের। বছরে গড়ে দুই হাজার ৭৮৭ জন, অর্থাৎ দৈনিক গড়ে আটজন। বিভিন্ন রকমের দুর্ঘটনার কারণে বছরে প্রায় দুই কোটি লোক আহত হয়, যার মধ্যে দুই লাখ ৪১ হাজার মানুষ ছোট-বড় পঙ্গুত্ববরণ করে। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত আহতের সংখ্যা সর্বোচ্চ। দিন দিন বাড়ছে সড়কে বিশৃঙ্খলা ॥ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক সড়ক দুর্ঘটনা কারণ হিসেবে বলেন, গাড়ি কমেনি। দিন দিন বিশৃঙ্খলা বাড়ছে সকল সড়ক মহাসড়কে। সড়কের ভূমি ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নসিমন-করিমন ও অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে সমানতালে। অবৈধ চালক, ফিটনেসবিহীন পরিবহনের সংখ্যাও কমেনি। বছরে ৮-১০ ভাগ গাড়ি বাড়ছে। তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে প্রতিদিন ৩৩ জন মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে ৫০ জন। এর মধ্যে ১০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, দিনে নিহতের সংখ্যা মাত্র আটজন। এ প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ পরিসংখ্যান তৈরি করে। নানান হয়রানির কারণে বেশিরভাগ মানুষ দুর্ঘটনার পর মামলা করেন না। এ কারণে পুলিশের পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। মহাসড়কে ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ যানবাহন ॥ ঈদের আগে ও পরে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহনে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ফোর লেন মহাসড়কে রং সাইড দিয়ে গাড়ি চলাচলের কারণেও দুর্ঘটনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত তদারকির অভাবেই মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন অবাধে চলাচল করছে। দিন দিন বাড়ছে দুর্ঘটনার মাত্রা। ঈদের আগে ও পরে চারদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লেমুয়া সেতুর কাছে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে সিএনজি চালিত অটোরিক্সার সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মহাসড়কে অটোরিক্সাটি রং সাইড দিয়ে আসছিল। গত শনিবার নাটোর-পাবনা মহাসড়কের লালপুরে মিনি চ্যালেঞ্জার নামক একটি বাসের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। পুলিশ বলছে, লেগুনাটির ফিটনেস ও নিবন্ধন কিছুই ছিল না। যাত্রীদের অভিযোগ, চালক মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে যাত্রীরা বারবার চালককে বারণ করলেও তিনি পাত্তাই দেননি। যার খেসারত হিসেবে ১৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়। একই দিনে ফেনীর সদর উপজেলার তাকিয়া এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অটোকে একটি বাস চাপা দিলে একজনের মৃত্যু হয়। ২৬ আগস্ট বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের বিজয়ঘাট এলাকায় মাইক্রোবাস ভ্যানকে চাপা দিলে আরও একজনের মত্যু হয়। গত ২১ আগস্ট নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাস ও হিউম্যান হলারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১১ জন প্রাণ হারায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মহাখালী অভিমুখী ‘ঢাকা বস’ পরিবহনের বাস তিন চাকার এই বাহনটিকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে আটজনের মৃত্যু হয়, বাকিরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমটি ॥ সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। ঈদের আগে ও পরে দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কারণ অনুসন্ধান করবে ১০ সদস্যের এই কমিটি। সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ২৫ আগস্ট কমিটি গঠন করা হয়। ১০ দিনের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুর্ঘটনা তদন্তের কাজ শুরু করেছেন কমিটির সদস্যরা।
×