ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মেয়র, ওয়াসার এমডি, মন্ত্রী- কেউ কথা রাখেননি ॥ সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে ঢাকা

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ আগস্ট ২০১৮

  দুই মেয়র, ওয়াসার এমডি, মন্ত্রী- কেউ কথা রাখেননি ॥ সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে ঢাকা

শাহীন রহমান ॥ গত বছরের জুলাইয়ে এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আগামী বছর রাজধানী ঢাকায় কোন জলাবদ্ধতা থাকবে না। শুধু মন্ত্রী নয়, ঢাকার দুই মেয়র, ওয়াসার এমডি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা এক বছর সময় চেয়ে সে সময় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞার এক বছর পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু বাস্তবায়ন দেখতে পায়নি রাজধানীবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই আগের মতো জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছেন তারা। এমতাবস্থায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন সিটির বাজেট পেশ অনুষ্ঠানে অবলীলায় বললেন, জলজট-যানজট নিরসন তার দায়িত্ব নয়। জলজটের সমাধান করবে ঢাকা ওয়াসা। যানজটের সমাধান করবে অন্য সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণেই মূলত জলাবদ্ধতা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। রাজধানীর জলবদ্ধতা নিরসনের দাবি দীর্ঘদিনের। প্রায় ২ দশক ধরে ঢাকাবাসী একই দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মূলত সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় না থাকা, রাজধানীর জলাভূমি ভরাট করে ভবন নির্মাণ এবং খাল উদ্ধারে উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি ওয়াসার এমডি দাবি করেছেন জলাভূমি এবং খালগুলো ভরাট হওয়ার কারণেই মূলত এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর বাইরেও সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে প্রকট। বিশেষ করে বর্তমান আইনী কাঠামোয় খাল ও স্টর্ম ড্রেনেজ দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। আর রাস্তার দুই পাশের সারফেস ড্রেন দেখভালের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এগুলো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার যথাযথভাবে না করার ফলে জলাবদ্ধতা জনদুর্ভোগের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় স্বীকার না করে সমন্বয়হীনতার কথা বলে একে অপরকে দোষারোপ করছে। সমন্বয়হীনতার কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, আন্তরিকতা ও কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় জলাবদ্ধতা আজ চরম আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। ওয়াসা, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বেশিরভাগ সড়ক এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যেটুকু সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য রয়েছে, তাও খোঁড়াখুঁড়িতে তৈরি হওয়া খানাখন্দে ভরা। জলাবদ্ধ সড়কে খানাখন্দের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে আটকে পড়ছে বাস, কার, অটোরিক্সা ও রিক্সা। এতে রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং পরিবেশ সংগঠন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে পল্লী উন্নয়ন, সমবায় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেছিলেন প্রতিজ্ঞা করছি সামনের বছর থেকে এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছু দিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে। ঢাকার দুই মেয়র, ওয়াসার এমডি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা একবছর সময় চেয়ে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মন্ত্রীকে এবং তার মাধ্যমে নগরবাসীকে। কিন্তু মন্ত্রীর নির্দেশ, মেয়র ও ওয়াসা এমডির দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তব কোন প্রতিফলন নগরবাসী দেখছে না। এবছরও সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে জনজীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত হাঁটুপানি থেকে কোমরপানি জমছে। মেয়রকে হাঁটুপানিতে নেমে প্রতিশ্রুতি দিতেও দেখা গেছে। এতে আশ্বস্তও হয়েছিল নগরবাসী। কিন্তু এবছর এপ্রিলের শেষের দিকের বৃষ্টিতে আবারও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনের ঘোষণা অর্থহীন। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন এবং জনগণ তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেই জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান সম্ভব। ঢাকা মহানগরীতে এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলাভূমি, নিম্নাঞ্চল, খাল ও নদী ভরাট ও দখল, খাল ও নালা-নর্দমা আবর্জনায় ভরাট এবং নিয়মিত পরিষ্কার না করা, সংস্থাগুলোর দায়িত্বে অবহেলা, সমন্বয়হীনতা, জনসচেতনতার অভাব রাজধানীর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এবছর গ্রীষ্মকালেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এবছর শ্রাবণের শুরুর দিকে বৃষ্টি হয়নি। টানা খরার পর শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহের শেষে বর্ষার আসল রূপ দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি। তবে রাজধানীবাসীর জন্য বর্ষার এমন রূপ চরম দুর্ভোগ বয়ে আনছে। কেননা কর্মচঞ্চল নগরজীবনে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, যানজট অনেকাংশেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমর পানি। রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি। জলমগ্ন রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় গর্ত থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১ হাজার ২৩০ কি.মি. দক্ষিণ সিটির ১ হাজার কি.মি. এবং ওয়াসার বক্স কালর্ভাটসহ ৩৭০ কি.মি. ড্রেনেজ লাইন নিয়মিত পরিষ্কারের পর্যাপ্ত উদ্যোগ না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় রাজধানীর রাস্তাগুলো। রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকে প্রতিনিয়ত। শত শত কোটি টাকা খরচ করে এসব আবর্জনা পরিষ্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন করলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। বর্তমান সময়েও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম চলছে। এরপরও স্বস্তিতে নেই নগরবাসী। রাজধানীর অবশিষ্ট খালগুলো নিয়মিত দখল হচ্ছে, ড্রেন ও জলাশয় আবর্জনায় ভরাট হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই তাই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। প্রতিবছর জলাবদ্ধতায় সেবা সংস্থাগুলো নিজেদের ব্যর্থতার দায় একে-অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন রাজধানীতে মাত্র দুই শতাংশ জলাভূমি রয়েছে, যেখানে থাকার কথা ১২ শতাংশ, নিম্নাঞ্চল ভূমিদস্যুদের দখলে, ৬৫ খাল ও চারটি নদী ছিল, এখন সেগুলো নেই। এসব কারণে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন কিছুটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তার পরিসংখ্যান নিয়ে মতভেদ থাকলেও জলাভূমি, নি¤œাঞ্চল, খাল ও নদী ভরাট ও দখলের বিষয়টি কমবেশি প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা যে ২৬টি খাল দেখভাল করার কথা সেগুলো দখলমুক্ত ও পরিষ্কার করে প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে ওয়াসার গৃহীত উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি। খালগুলো দখলমুক্ত ও পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে ওয়াসার উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নগরবাসীর চোখে পড়ছে না। পাশাপাশি বক্স-কালভার্ট ও ড্রেনের ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা লাঘবে ২৬ খালের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে ওয়াসা এবং ড্রেন পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নেবে এটাই নগরবাসীর প্রত্যাশা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ১৯৮৯ সালে ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনে মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। ওয়াসা পানি সরবরাহের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পানি নিষ্কাশনে নজর দেয়ার সময় নেই। আর এর ফলে ভুগছে নগরবাসী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন জলজট-যানজট নিরসন তার দায়িত্ব নয়। জলজটের সমাধান করবে ঢাকা ওয়াসা। যানজটের সমাধান করবে অন্য সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির পানি ড্রেনের মাধ্যমে স্ট্রম স্যুয়ারেজে যাবে, সেখান থেকে খালে, খাল থেকে নদীতে পড়বে। দীর্ঘ এই পথের প্রতিটি অংশ নির্বিঘœ হতে হবে। কোথাও এটি বাধাপ্রাপ্ত হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলো পুনরুদ্ধার করে সেগুলো নিয়মিত তদারকি, পরিচর্যা ও পরিষ্কার করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। তারা বলেন, নগরবাসীকে জলজট-যানজট থেকে মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। বাস্তবে ভোগান্তি কমছে না বরং প্রতি বছর বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় স্বীকার না করে একে অপরকে দোষারোপ করছে। প্রত্যেকটি সংস্থা ও জনগণ নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাব পালন করলে জলাবদ্ধতা, যানজটসহ বিভিন্ন সমস্যা বহুলাংশে কমে যাবে। বর্তমানে নগর-মহানগরের অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনায় সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। নগর-মহানগরের নিচু জায়গা, পুকুর, খাল, জলাধার, নদী ইত্যাদি ভরাট করে গড়ে উঠছে রাস্তা ঘাট, শিল্প কারখানা এবং সুরম্য অট্টালিকা। ফলে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের পথ।
×