ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহহীনদের তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২০ জুলাই ২০১৮

গৃহহীনদের তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাউফল, ১৯ জুলাই ॥ গৃহহীনদের তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। জায়গা-জমি ও ঘর আছে এমন ব্যক্তিকেও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তালিকায় নাম রয়েছে, ইউপি সদস্য ও তাদের স্বজন, শিক্ষক এবং অনেক ধনী ব্যক্তিদের। সরেজমিনে এমন চিত্র পাওয়া গেছে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ‘যার জমি আছে, ঘর নেই তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ উপ-খাতের আওতায় বাউফল উপজেলার চন্দ্রদ্বীপ ও কাছিপাড়া ইউনিয়নে ১৫১টি গৃহ নির্মাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) অনুকূলে ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নে ১শ’টি ও কাছিপাড়া ইউনিয়নে ৫১টি গৃহ নির্মাণ ব্যয় নির্বাহ করা হবে। ইতোমধ্যে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত কাউকে ওই টাকা দেয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, গৃহহীন ব্যক্তিদের ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত জমি থাকতে পারবে। প্রত্যেককে গৃহ নির্মাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য ১ লাখ করে টাকা দেয়া হবে। অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে কোন প্রকার যাচাই-বাছাই না করেই সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউএনও দরিদ্র ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে ধনী ব্যক্তিদের নাম গৃহহীনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গৃহহীনদের ওই তালিকায় ১০ নম্বর ক্রমিকে নাম রয়েছে চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চর রায়সাহেব গ্রামের মোঃ মস্তফা ফকিরের। অথচ তিনি ওই এলাকার সম্পদশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তার রয়েছে ২০টির অধিক মহিষ, জমি আছে ২৫ একরেরও বেশি। ঘরও আছে অনেক বড় আকারের। ওই তালিকার ৮৯ নম্বর ক্রমিকে নাম রয়েছে একই ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ দুলাল সিকদারের। ৭৬ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ আবুল বশার মৃধার নাম এবং তালিকার ৩৭ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে তার মা সৈয়দ নেছা বেগমের নামে। এ রকম আর্থিক অবস্থা ভাল এবং ঘর আছে এমন ব্যক্তিদের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। অথচ একই ইউনিয়নের ডিয়ারা কচুয়া গ্রামের ইউনুচ জোমাদ্দার, সামসুল হক হাওলাদার এবং চরমিয়াজান গ্রামের মোঃ জসিম হাওলাদার, আকবর খান, মোঃ ছিডু হাওলাদার, মোঃ সেলিম হাওলাদার এবং চরব্যারেট গ্রামের খোরশেদ আলম, ছাদের আলী, আবদুর রাজ্জাক খান, সোহাগ মিস্ত্রী, ফিরোজ হাওলাদার, অলি মাঝি, আনোয়ার রাঢ়ি, বিধবা মোসা. রুনু বেগম ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন। এরা খুবই দরিদ্র। এদের মধ্যে আবার সামসুল হক প্রতিবন্ধী, ছাদের আলী ভিক্ষা করেন ও রুনু বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছাদের আলী বলেন, ‘টাকা দিতে পারি নাই। হেইয়ার লইগা ঘরের তালিকায় আমাগো নাম নাই।’ খোরশেদ আলম দুঃখ করে বলেন,‘সিডরের সময় আমার পাঁচ সন্তান পানিতে ভেসে গেছে। এখনও থাকি অন্যের বাড়িতে। ওই সময় সরকারীভাবে ঘর দেয়া হলেও পাইনি। পেয়েছে ধনী ব্যক্তিরা। যা তারা জ্বালানিকাঠ রাখার ঘর হিসেবে ব্যবহার করেন। অথচ আমার মতো গরিবদের থাকার মতো ঘর নেই।’এইবারের গৃহহীনদের তালিকায় তার নাম নেই। এদিকে তালিকায় নাম না থাকায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন চরমিয়াজান গ্রামের নূর মোহাম্মাদ মোল্লা (২৭)। পেশায় তিনি জেলে। তিনি বলেন,‘ঘর নাই। হক্কোলে কইছে আমার মতো গরিবে ঘর না পাইলে পাইবো কেডা।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, তালিকায় ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জনই ধনী ও সম্পদশালী এবং তাদের ঘর আছে। চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাস মোল্লা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ইউপি সদস্যরা তালিকা করেছেন। সেই তালিকাই ইউএনও বরাবরে পাঠানো হয়েছে।’ এদিকে কাছিপাড়া ইউনিয়নে যে ৫১ ব্যক্তির নাম গৃহহীনদের তালিকায় নাম রয়েছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই সচ্ছল। তালিকায় ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সেলিম হাওলাদারের দুই ছেলে সাজেদুর রহমান ও মোঃ সাইফুল হাসানের নামও আছে। এছাড়াও সেলিম হাওলাদারের স্ত্রীর তিন ভাই মোঃ সিদ্দিক মোল্লা, মোঃ ইদ্রিস মোল্লা মোঃ আবদুস সত্তার মোল্লার নাম আছে। সেলিম হাওলাদারের ভগ্নিপতি জালাল শরীফেরও নাম আছে গৃহহীনদের তালিকায়। তবে এরা সবাই সচ্ছল। তালিকার ১২২ নম্বরে রয়েছে আবুল বাশারের নাম। তিনি ছিলেন প্রবাসী। বাড়িতে রয়েছে দোতলা পাকা ভবন। ১২৬ নম্বর ক্রমিকে আছে ফরিদা বেগমের নাম। তার তিন ছেলে চাকরি করে। স্বামী কামাল সিকদার নিজের জমিজমা দেখভাল করেন। রয়েছে টিনশেড বড় ঘর। তালিকার ১২০ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে কামাল সিকদারের আপন ভাই আইয়ুব আলী সিকদারের নাম। এরা সবাই ধনী প্রকৃতির। তালিকার ১৪২ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে অপু ব্যানার্জীর নাম। তিনি কাছিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি সদস্য বলেন,‘অনেক অনিয়ম হয়েছে।’ এ ব্যাপারে কাছিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম তালুকদার টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নাম দেয়ার সময় তলিয়ে দেখা হয়নি। সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম বাতিল করা হবে।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পিজুস চন্দ্র দে বলেন,‘আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। আর আমার যোগদানের আগেই এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে গৃহহীনদের তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম থাকার কোন সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
×