ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

টিএ্যান্ডটি অপারেটর কাজী হাফিজুর রহমানের আত্মকথন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৯ মে ২০১৮

টিএ্যান্ডটি অপারেটর কাজী হাফিজুর রহমানের আত্মকথন

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥ কমে গেছে শ্রবণশক্তি, চোখে ঝাপসা দেখেন, বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে দেহ, হ্রাস পেয়েছে স্মরণশক্তি, অনেক কিছুই মনে নেই, এ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা যতটুকু মনে পড়েছে ততটুকুরই স্মৃতিচারণ করলেন ’৭১-এ মাদারীপুর মহকুমার টিএ্যান্ডটি অপারেটর কাজী হাফিজুর রহমান। তিনি এই ঘোষণার খবর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের কাছে শুধু পৌঁছেই দেননি। তিনি হানাদার বাহিনীর ভেতরে সরকারী চাকরি করেও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোপন খবরাখবর পৌঁছে দিতেন। মাটির নিচ দিয়ে টেলিফোনের তার টেনে ডনোভান স্কুলের পেছনের গভীর জঙ্গলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার এ দূরদর্শিতা ও সাহসিকতার কোন মূল্যায়ন করা বা স্বীকৃতি দেয়া হয়নি মুক্তিযোদ্ধা বা সহ-মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। এমন কি স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর কেটে গেলেও কোন দিন তার খোঁজখবরটুকু নেয়নি কেউ। তার কষ্টের কথা শুনতে কেউ আগ্রহটুকু প্রকাশ করেনি। কাজী হাফিজুর রহমানের জন্ম ১৯৪৩ সালে। তার বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার ধানডোবা গ্রামে। পিতা ছিলেন কাজী আবদুল হক। বর্তমানে মাদারীপুর শহরের ২নং শকুনী রোডে বসবাস করছেন। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি ছিলেন নরসিংদীর মনোহরদী ট্র্যাঙ্কল অফিসে কর্মরত। তিনি সেপ্টেম্বর মাসেই সেখান থেকে বদলি হয়ে মাদারীপুর মহকুমা টিএ্যান্ডটি অফিসে অপারেটর হিসেবে যোগদান করেন। কাজী হাফিজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের একজন পরীক্ষিত সৈনিক। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তখনই পশ্চিমাদের ভিত কেঁপে ওঠে। শুরু হয় বাঙালী জাতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা। ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা বুনতে থাকে তারা। তখনই বাঙালী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন পশ্চিমাদের গভীর ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১-এর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। সারাদেশ ফুঁসে ওঠে এবং প্রস্তুতি নিতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের। গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। সারাদেশের মতো মাদারীপুরেও শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধেও প্রস্তুতিমূলক মহড়া। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি মার্চের প্রথম থেকে শুরু হলেও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে গণহত্যা শুরু করে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে হানাদার বাহিনী অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহ, সাধারণ আবাসিক এলাকায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে অসংখ্য বাঙালী পুলিশ সদস্য, বাঙালী ইপিআর সদস্য, বহু ছাত্রনেতা এবং অগণিত বাঙালী নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং ওই রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার এ বার্তা ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সারা দেশের আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে যায়। এ সংবাদটি ফরিদপুর টিএ্যান্ডটি অপারেটর আবদুল কুদ্দুছ মাদারীপুর টিএ্যান্ডটি অপারেটর কাজী হাফিজুর রহমানকে জানান। তখন মাদারীপুর মহকুমা টিএ্যান্ডটি অপারেটর ছিলেন কাজী হাফিজুর রহমান ও আবদুস সামাদ। এ খবর কাজী হাফিজুর রহমান তৎকালীন টিএ্যান্ডটির পিয়ন রেজ্জেক মিয়াকে পাঠিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান সিকদারকে জানান। সংবাদটি মুহূর্তের মধ্যে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনীর ঢাকায় আক্রমণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান সিকদার এ সংবাদ পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি চলে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপিএ মৌলভী আচমত আলী খানের বাড়ি। এ সময় মৌলভী আচমত আলী খান তার ছেলে ছাত্রনেতা শাজাহান খানকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তারা ফণীভূষণ মজুমদারের বাড়ি গিয়ে তাকে এ সংবাদ অবহিত করে সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু ভূঁইয়ার বাড়ি থেকে সরোয়ার হোসেন মোল্লা ও বাচ্চু ভূঁইয়াকে ডেকে নিয়ে আসেন। আসার সময় পুরনো কোর্টের মোড়ে দেখা হয় আওয়ামী লীগের সদস্য নূরুল আলম বাবু চৌধুরীর সঙ্গে। এ সময় বাবু চৌধুরী বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন তারা বিস্তারিত সংবাদ জানার জন্য বাবু চৌধুরীকে থানায় পাঠান। ওসি জয়নাল আবেদীন বাবু চৌধুরীকে জানান, ফরিদপুর থেকে এসপি মিহির কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। থানা থেকে ফিরে এ খবর তিনি নেতাদের জানান। কাজী হাফিজুর রহমানের ওই খবরের ওপর ভিত্তি করে রাতে আচমত আলী খানের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির জরুরী সভা। সভায় তাৎক্ষণিক শহরে মাইক নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। বাবু চৌধুরী এবং এ আর হাওলাদার জুট মিলের সিকিউরিটি অফিসার বাদশা হাওলাদার লতিফ কাজীর মাইকের মাধ্যমে ঢাকায় হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সংবাদ এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর প্রচার শুরু করেন। মাইকিং করে সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে আহবান জানিয়ে সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়। সেদিন শহরের অলিগলিতে বিরামহীন রাতভর মাইকিং চলে। বিক্ষুব্ধ মাদারীপুরবাসী পাড়া-মহল্লা থেকে খ--খ- জঙ্গী মিছিল নিয়ে পথে নেমে আসে। মুহূর্তের মধ্যে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় গোটা মাদারীপুর। এ সংবাদ পৌঁছে যায় থানায় থানায় গ্রামগঞ্জে। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষ। কাজী হাফিজুর রহমান খবরটি মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াতকে জানান। হাফিজুর রহমানের মুখে খবর পেয়ে এসডিও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন ‘আল্লাহ ভরসা’ সংবাদটি জানিয়ে খুব ভাল কাজ করেছ। ২৫ মার্চ রাতে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর সদর থানার ওসি জয়নাল আবেদীনও টেলিফোন করে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াতকে অবগত করেন। এসডিও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত এবং মুক্তিপাগল একজন বাঙালী অফিসার। ২৭ মার্চ সকালে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির লোকজন এসডিওর বাসায় উপস্থিত হন। এ সময় শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে শত শত মানুষ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসডিওর বাসার সামনে ভিড় জমায়। অবস্থা দেখে মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত খুশি হন এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। তখন এসডিপিও মো. আবদুল মান্নানসহ উপস্থিত সকল বাঙালী অফিসার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মহকুমা প্রশাসকের সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় যুবকদের থানা ও ট্রেজারি থেকে রাইফেল সরবরাহ করে পুলিশ লাইন মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৯৭১ সালে টিএ্যান্ডটি অফিস ছিল বর্তমান মূল ভবনের পশ্চিম পাশের একতলা ভবন। আর টেলিগ্রাম অফিস ছিল উত্তর পাশের টিনের ঘর। হানাদার বাহিনী মাদারীপুরে প্রবেশ করে অন্যান্য স্থাপনার মতো টিএ্যান্ডটি অফিস নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়। সে সময় হানাদার বাহিনীর মধ্যে অবস্থান করে কাজী হাফিজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীনতার জন্য যে অবদান রেখেছেন, তার অবদানের কথা কেউ মনে না রাখলেও যারা এ বিষয়টি জানেন তারা চিরকাল কাজী হাফিজুর রহমানের নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
×