ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন মাত্রায় বজ্রপাত, কয়েক শ’ মানুষের মৃত্যু

হাওড়ে অকাল বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, বিধ্বংসী পাহাড় ধস

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওড়ে অকাল বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, বিধ্বংসী পাহাড় ধস

শাহীন রহমান ॥ ২০১৭ সাল। এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন একটু ভিন্ন মূর্তিতেই আবির্ভূত হয়েছিল। প্রায় সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল রূপ প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। শুধু ভয়াল রূপ নয়, এর প্রভাবে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, লোকজন বাস্তুহারা, অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্ভোগসহ সব ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বছর পার করতে হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও একসঙ্গে এত দুর্যোগের সম্মুখীন অতীতে হতে হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। গত এপ্রিলে অকালবন্যায় হাওড়ের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষত বোধ করি এখানও শুকায়নি। দুই দফা বন্যা উত্তরের জনগণকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছিল। বৈচিত্র্যহীন শীত ঋতু দিয়ে শুরু এ বছর। শীত সাধারণত ডিসেম্বরে এলেও পুরো জানুযারি জুড়ে এখানে শীত পড়ে। সবচেয়ে বেশি শীত এই মাসেই নামে। তবে এই বছর জানুয়ারিতে শীতের ব্যাপক বৈচিত্র্যহীন রূপ প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। জানুয়ারি মাস মনে হয়েছে শীতের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে শীতের এমন আচরণ। তবে ভরা মৌসুমে শীতের দেখা না পেলেও মার্চ জুড়ে শীতের আবহ ছিল। অকালে শীত পড়ায় রোগবালাইয়ের আধিক্য ছিল। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নতুন যোগ হয়েছে বজ্রপাত। বজ্রপাত দেশে নতুন না হলেও সাম্প্রতিক এর হার অনেক বেড়েছে। বজ্রপাতে বছরে কয়েক শ’ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই সাম্প্রতিক বজ্রপাত বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় ঠাঁই দেয়া হয়েছে। প্রতিবছর মার্চ থেকে এর আবির্ভাব হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারী এক হিসেবে দেখা গেছে, চলতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বজ্রপাতে ১৭৭ জনের মৃত্যু রয়েছে। এর মধ্যে মার্চে ১৩ জনের, এপ্রিলে ৫০, মে’তে ৫৩, জুনে ৪৬, জুলাইয়ে ১৫ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। প্রতিবছর শীত শেষে বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ আঘাত হানছে। সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষার উপায় এখনও জানা নেই কার। অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে এক সময় এই অঞ্চলের নাম ছিল চিরহরিৎ অঞ্চল। বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এক সময় চিরহরিৎ বনাঞ্চলে আচ্ছাদিত ছিল। বিগত বছরগুলোতে বৃষ্টিপাত তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না। কোন কোন বছর বৃষ্টিপাতের দেখা মিলছে না। আবার কোন কোন বছরে বৃষ্টিপাতের ব্যাপক আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সময়ে বৃষ্টিপাতের দেখা না মিললেও বৃষ্টিপাত তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অসময়েই ঝরছে। এবার বছরের শুরুতে বৃষ্টিপাতের আধিক্য ছিল। স্বস্তির পাশাপাশি ভোগান্তি কাকে বলে তা এ বছর বৃষ্টিপাতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে দেশবাসী। মার্চ থেকেই বৃষ্টিপাতের শুরু। কখনও কখনও অকালে বৃষ্টিপাতের কারণে ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছে। বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি করে দিয়েছে এই বৃষ্টিপাত। আবার পাহাড় ধসে মানুষ মৃত্যুর মিছিলেও পরিণত হয়েছে। এপ্রিলের বৃষ্টিপাত প্রথমবারের মতো চার দশকের রেকর্ড ভঙ্গ করে। আবহাওয়া অফিসের হিসাব মতে, এবার মাস হিসেবে এপ্রিলে যত বৃষ্টিপাত হয়েছে তা ১৯৮১ সালের পর আর হয়নি। এখানেই থেমে থাকেনি বৃষ্টিপাত। ঘণ্টা হিসেবেও এবার রেকর্ড হয়েছে। গত ২ আগস্ট রাজধানীতে তিন ঘণ্টায় ১২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের যে রেকর্ড করা হয় তা অতীতে কখনও হয়নি। তারা জানায়, ২০০৩ সাল থেকে আবহাওয়া অফিস ৩ ঘণ্টার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আসছে। কিন্তু এর আগে এত কম সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতের রেকর্ড তারা পায়নি। বৃষ্টিপাতের এই ধারা বছরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দেশের সব সিটি কর্পোরেশন, শহর একাধিকবার বৃষ্টিপাতের কারণে তলিয়ে যায়। নৌকার ব্যবহার শুরু হয় রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে। রাজধানী ছয়বার বৃষ্টিপাতে ডুবে যায়। ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হয় জনগণ। একটানা বৃষ্টিপাতের ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার। এতে সারাদেশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির হয়। বৃষ্টিপাতের ধারা বলতে গেলে এখনও শেষ হয়নি। হাওড়ে অকালবন্যা এদেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের এই বন্যার যে বিধ্বংসী রূপ ছিল তা হাওড়বাসী সারা জীবন মনে রাখবে। এবারের মতো ভয়াবহ বন্যা তারা আগে কখনও লক্ষ্য করেনি। বন্যায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। জীবন করে তোলে দুর্বিষহ। বন্যার ক্ষত এখানও শুকায়টি তাদের। এর ফলে ফসলহানির পাশাপাশি মানুষ বাস্তুচ্যুতও হয়েছে। এপ্রিল মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে হাওড়ের ৭ জেলার মানুষ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। বেসরকারী সংগঠন পরিবেশ এবং হাওড় উন্নয়ন সংস্থার তথ্য মতে, হাওড়ে বন্যায় ৭৫ ভাগ ফসল তলিয়ে যায়। মানুষ যখন ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনি এই অকালবন্যা সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে যায়। বেসরকারী ওই সংস্থার হিসাব মতে, ২২ লাখ টন ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ পরিবারের এই বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। কারও ঘরববাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি সবকিছুই পানিতে মরে পচে পরিবেশ ভারি করে তোলে। ষাটের দশকের আগে এখানে পাহাড় ধসের ঘটনা কমই ঘটতে দেখা গেছে। এই দশকের আগে এই ঘটনায় মৃত্যুর কোন রেকর্ড নেই। এ বছর পাহাড় ধসে যে মৃত্যু হয়েছে তা অতীতে আর হয়নি। গত জুনের ১২ এবং ১৩ তারিখ পরবর্তী আরও কয়েক দফা বৃষ্টিপাতে একাধিকবার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১৬০ ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম তার গবেষণায় দেখান; বিগত চার দশকের মধ্যে এবারের পাহাড়ধস ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তিনি বলেন, এর আগে ২০০৭ সালে পাহাড়ধসের ঘটনায় ১২৭ জনের মৃত্যু ঘটে। এবারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ধস ছিল বিধ্বংসী। তবে এটাকে বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সবচেয়ে বড় যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ বছর আঘাত হেনেছে তা হলো দুই দফার বন্যা। ফসলের ক্ষতি থেকে শুরু করে বন্যায় মানুষকে সর্বস্বান্ত পর্যন্ত হতে হয়েছে। এর ক্ষত এখানও উত্তরাঞ্চলের মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারী হিসেবে এবারের বন্যায় ৩৩ জেলায় প্রায় ৭০ লাখের বেশি মানুষের ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। বন্যায় ডুবে ৬ লাখ হেক্টরের বেশি জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ জনগণের বসতভিটা, কাঁচাপাকা রাস্তা, প্রধান সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। উত্তরাঞ্চলের মানুষের দাবি, এ বছর যে বন্যা হয়েছে তা অতীতে কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, এবারের বন্যায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার যে লেভেল অতিক্রম করেছে তা অতীতের যে কোন সময়ে বন্যার চেয়ে বেশি ছিল। ঘর্ণিঝড় প্রতিবছর কয়েকবার করে আঘাত হানে। এবারও এসেছিল। তবে ‘মোরা’র বিধ্বংসী আঘাতে ৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। পাশাপাশি লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূলের জীবনযাত্রা। গত ৩০ মে দেশের উপকূলে আঘাত হানে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। এবারের ঘূর্ণিঝড় ছিল অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে ঘূর্ণিঝড়ে ১০ নম্বর সিগন্যাল টানিয়ে দেয়া হয়। এবারের মোরা আসার সময়ই ১০ নম্বর সিগনালই ব্যবহার করা হয়েছে। আবহওয়া অফিসের হিসেবে ১০ নম্বরের উপরে ১১ নম্বর সিগনাল রয়েছে; যার মানে হলো যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সিগন্যাল। এটি তখন ব্যবহার করা হয় যখন আবহাওয়া অফিস ঝড়ের বিষয়ে আর কোন খোঁজখবর দিতে পারছে না। সংকেত প্রদানকারী কেন্দ্রের সঙ্গে সব যোগাযোগ যখন বিচ্ছিন্ন তখন স্থানীয় যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ভাষায় ‘মোরা’ এতই শক্তিশালী ছিল যে সর্বোচ্চ সিগনাল দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষ বন্যা, প্লাবন, ঝড়ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে পরিচিত। তবে এবার সব প্রাকৃতিক দুর্যোগই মহামারি হয়ে দেখা দেয়। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত করেই চলেছে। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ দেশের ভূপ্রাকৃতিক গঠন এবং অবস্থানের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এবার সবই যেন একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। অতীতে যা লক্ষ্য করা যায়নি।
×