ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফে সক্রিয় ইয়াবা চক্র

প্রকাশিত: ০৪:২০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

টেকনাফে সক্রিয় ইয়াবা চক্র

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সাধারণ রোহিঙ্গারা পালিয়ে এলেও আসেনি দেশটির ইয়াবা সম্রাটরা। সিটওয়ে (আকিয়াব) ও মংডুতে স্থাপিত ৩৮টি কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবাগুলো বিক্রির জন্য বাংলাদেশকে প্রধান মার্কেট মনে করে ইয়াবা সম্রাটরা চালান পাঠাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা ৩৮টি ইয়াবা কারখানা থেকে প্রতিদিন টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ২০টি স্থান ও সাগরপথে পাঠানো হচ্ছে লাখ লাখ ইয়াবা। জানা যায়, মিয়ানমারের মংডু থেকে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং বোটের মাধ্যমে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নাজিরপাড়া, মৌলবিপাড়া, জালিয়াপাড়া, মাঝিরপাড়া, নাইট্যংপাড়া, লেজিপাড়া, উখিয়ার বালুখালী, রহমতেরবিল, আঞ্জুমানপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, ঘুমধুম, ও তুমব্র পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই লাখ লাখ ইয়াবা ঢুকছে দেশে। রোহিঙ্গার ঢল সামাল দিতে প্রশাসন ব্যস্ত থাকার সুযোগে সিন্ডিকেট সদস্যরা অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা কারবার। টেকনাফ পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তার সঙ্গে ইয়াবা সিন্ডিকেটের সখ্য ও গোপন লেনদেন থাকায় ইয়াবা প্রবেশ রোধ করা যাচ্ছে না বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, টেকনাফের সাহপরীরদ্বীপ, নয়াপাড়া, নাজির পাড়া, জালিয়াপাড়া ও হ্নীলাসহ অন্তত উপজেলার সাত শতাধিক ইয়াবা বিক্রেতাদের তালিকা রয়েছে পুলিশের ডায়েরিতে। তন্মধ্যে দেড়শ জনের কাছ থেকে টেকনাফ থানা পুলিশ মাসিক এক থেকে দুই লাখ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করে থাকে। শুধুমাত্র ইয়াবা সিন্ডিকেট থেকে প্রতি মাসে টেকনাফ পুলিশ অন্তত দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে প্রকাশ, মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ ইয়াবা পাইকারি বেচাকেনা কাজে উপজেলা পর্যায়ের এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি গোপনে মদদ যুগিয়ে থাকেন। ওই রাঘববোয়ালের নিয়ন্ত্রণে এখন ইয়াবা আনা ও সরবরাহ কার্যক্রম চলছে টেকনাফে। ওই গডফাদার (নব্য আওয়ামী লীগ নেতা) টেকনাফ পুলিশকে ম্যানেজ করে ইয়াবা বিক্রির পথ সুগম করে দিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইতোপূর্বে ইয়াবার চালানসহ দেশের এবং মিয়ানমারের বহু নাগরিক ধরা পড়েছে। মংডু, সিটওয়েসহ কয়েকটি এলাকায় বসতবাড়িতে ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে বলে তারা প্রশাসনের কাছে স্বীকারও করেছে। ইতোপূর্বে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানে ইয়াবা গডফাদাররা গা ঢাকা দিলেও বর্তমানে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। সূত্র আরও জানায়, টেনাফের নাজিরপাড়ার ইয়াবা গডফাদার খ্যাত রফিক পুলিশের পক্ষে তালিকাভুক্ত ইয়াবা বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা উঠিয়ে থাকে। এক সময় ওই রফিকও মাসিক এক লাখ টাকা হারে চাঁদা দিত টেকনাফ পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তাকে। মধ্যখানে রোহিঙ্গার ঢল নামার সময় ইয়াবা বিক্রিতে ভাটা পড়লে রফিক এক মাসের টাকা প্রদানে বিলম্ব করে। এ জন্য কিছুদিন আগে টেকনাফ থানার একজন এসআই ওই রফিককে ধরে এনে ক্রস ফায়ারের হুমকি দেয়। পরবর্তীতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দিয়ে স্বজনরা রফিককে ছাড়িয়ে নিয়েছে থানা থেকে। পুলিশের পকেটে যাওয়া মোটা অঙ্কের ওই টাকার ক্ষতি পুষাতে সুযোগ হিসেবে রফিককে পুলিশের মাসিক চাঁদা উঠানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইয়াবা সম্রাট রফিক নাজিরপাড়ার বহু মামলার পলাতক আসামি দুই সহোদর আবছার ও কামালকে বশে এনে প্রতিরাতে দেদারছে ইয়াবা আনছে মিয়ানমার থেকে। সন্ত্রাসী আবছার ও কামালের অবৈধ অস্ত্রের ভয়ে স্থানীয় কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে, মিয়ানমারের চিকুইন্না, রশিদ, বমং, আয়াতুলাহ ও সৈয়দসহ ২০ জন শীর্ষ ইয়াবা ডিলার মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা সরবরাহ করছে। তন্মধ্যে ১৫টি কারখানার ডিলার হচ্ছে রোহিঙ্গা সিরাজুল ইসলাম প্রকাশ চিকুইন্না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কুয়াংচিবং গ্রামের ফয়েজুল ইসলামের পুত্র দেশটির পুলিশ বাহিনীর (বিজিপি) বিশ্বস্ত দালাল সিরাজুল ইসলাম প্রকাশ চিকুইন্না পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া, বালুখালী ও রহমতের বিল দিয়ে অবাধে বাংলাদেশে মরন নেশা ইয়াবার চালান ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই সর্ববৃহৎ ইয়াবা ডিলার সিরাজুল ইসলাম প্রকাশ চিকুইন্না চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থেকে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে রয়েছে তালিকাভুক্ত ৭শ ইয়াবা পাচারকারী। তন্মধ্যে অন্তত দেড়শ কারবারি পুলিশকে মাসিক লাখ টাকা হারে চাঁদা দিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে টেকনাফের হ্নীলা লেদা গ্রামের নুর মোহাম্মদ ও নুরুল হুদা ট্রাকের হেলপার থেকে ইয়াবা কারবার করে অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলেছে। শীর্ষ গডফাদার হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় রয়েছে তাদের নাম। ২০১৪ সালে র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছে নুর মোহাম্মদ। এরপর থেকে নামে বেনামে একাধিক ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ছাড়াও নুরুল হুদা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। ওই নুরুল হুদা মেম্বারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না বলে জানা গেছে। শহরের টেকপাড়া মাঝিরঘাট এলাকায় আলিশান বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী ছলিম উল্লাহ। ২০১৫ সালে নির্মাণাধীন অবস্থায় নির্মাণের অনুমতির জন্য পৌরসভার কাছে আবেদন করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয়া হয়নি তাকে। এই ভবন নির্মাণের জন্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেও কোন ধরনের অনুমতি নেয়নি বলে জানা গেছে। ২০১৬ সালে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। তারপরও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সহযোগিতায় অনুমোদনহীন বহুতল ভবনটি নির্মাণ করে যাচ্ছে।
×