স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় সচিবালয়, শাহবাগ, জাতীয় প্রেসক্লাব, হাইকোর্টসহ আশপাশের এলাকায় রীতিমতো তান্ডব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তান্ডবের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার জন্য জনজীবন থেমে গিয়েছিল। মারাত্মক বিপাকে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সেগুনবাগিচা বারডেম-২ হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনরা। তান্ডবের সময় মানুষ প্রাণভয়ে দোকানপাট, প্রিয় গাড়িসহ অন্যান্য সামগ্রী ফেলে পালিয়ে গেছেন। হামলাকারীরা অন্তত শতাধিক যানবাহন ভাংচুর করেছে। ভাংচুরের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বিডিআর বিদ্রোহের মামলার বিচারক হাইকোর্টের বিচারপতি নজরুল ইসলামের প্রটেকশন গাড়িও। এছাড়া নির্বিচারে ভাংচুর করা হয়েছে শিশু, কিশোর, স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষকে বহনকারী যানবাহনও। তান্ডবের সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষে পুলিশ, পথচারীসহ নানা শ্রেণী পেশার অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ বিএনপির ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ফুটবলার আমিনুল ইসলামসহ ২৫ জনকে আটক করেছে।
অনেকেই বলছিলেন, শুধু ভাংচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি নেতাকর্মীরা। ভাংচুরের পর প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অনেক গাড়ির মালিক কাকুতি মিনতি করেছে। তাতে মন গলেনি বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। অনেককে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দিয়ে গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। আগুন দেয়ার সময় অনেকেই প্রিয় গাড়িকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের হাতে পায়ে পর্যন্ত পড়েছেন। গাড়ি থেকে পেট্রোল বের করে সেই পেট্রোলেই গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ারও ঘটনা ঘটেছে। তা-বের মাত্রা বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তা-বের মাত্রার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
মঙ্গলবার পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের কারা অধিদফতরের মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে জিয়া এতিমখানা ও দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাক্ষ্যগ্রহণ ছিল। শাহবাগ থানা পুলিশ জানায়, খালেদা জিয়ার হাজির হওয়ার কথা ছিল বেলা এগারোটার দিকে। এর আগ থেকেই বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের কয়েকশ নেতাকর্মী নাজিমউদ্দিন সড়কের আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় জড়ো হতে থাকে। তারা শান্তিপূর্ণভাবেই অবস্থান করছিল। তবে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল তুলনামূলক অনেক বেশি। খালেদা জিয়ার গাড়িবহর ফেরার পথে নেতাকর্মীরা অনেকটাই ইচ্ছে করেই রাস্তা থেকে জোরপূর্বক যানবাহন সরিয়ে দিতে যায়। এ নিয়েই মূলত ঘটনার সূত্রপাত হয়। পুলিশ স্বাভাবিকভাবেই রাস্তা থেকে যানবাহন ততক্ষণে সরিয়ে দিয়েছে। যে কয়েকটি যানবাহন আটকা পড়েছে, তারা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা ইচ্ছে করেই নেতাকর্মীরা সেসব গাড়ি জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। শুরু হয় কথাকাটা কাটি।
বেলা তিনটার দিকে একপর্যায়ে আচমকা নেতাকর্মীরা গাড়ির ওপর চড়াও হয়। তারা বিনা উস্কানিতে হাইকোর্টের সামনে শিক্ষা ভবন ও খাদ্য ভবনের সামনে থাকা কয়েকটি গাড়ি চোখের পলকে ভেঙ্গে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হামলাকারীরা গাড়ি ভাংচুর শুরু করে। হামলাকারীরা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, তাদের কোনক্রমেই প্রতিহত করা যাচ্ছিল না। হামলাকারীদের তন্ডবে পুরো এলাকা মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। অনেকেই দোকানপাট ফেলে পালিয়ে যায়। আর যানজটে আটকা পড়ে থাকা অনেক গাড়ির চালক জীবন বাঁচাতে গাড়ি রেখেই দৌড়ে কোনমতে জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। ফেলা যাওয়া গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব পেট্রোল আগ থেকেই হামলাকারীরা সঙ্গে রেখেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর অনেক মোটরসাইকেলের পেট্রোল বের করে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাংচুরের হাত থেকে রক্ষা পায়নি রোগী, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষজনসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ বহনকারী যানবাহনও।
পুলিশ বাধা দিলে হামলাকারীরা বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। হাইকোর্ট থেকে মৎস্যভবন পর্যন্ত পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিএনপি-জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা বঙ্গবাজারের সামনের সড়কেও যানবাহনে ভাংচুর ও বিক্ষোভ করে। সেখানে তারা একটি মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হামলাকালে অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে নেতাকর্মীদের গাড়ি না ভাঙ্গার জন্য হাতে পায়ে ধরেছেন। তাতে মন গলেনি। উপরন্তু তাদের সামনেই প্রকাশ্যেই গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অনেককে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে গাড়িতে আগুন দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এবারের তা-ব কোন অংশেই ২০১৪ ও ২০১৫ সালের সারাদেশে লাগাতার হরতালের নামে আগুন সন্ত্রাসের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। এবার তবু ভাল গাড়ি থেকে লোকজনদের জোরপূর্বক বের করে দিয়ে আগুন দিয়েছে। গাড়ির ভেতরে মানুষ রেখেই গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া বিচিত্র ছিল না। ভাংচুর করা হয়েছে একজন বিচারকের প্রটেকশন গাড়িসহ কয়েকটি সরকারী যানবাহনও। তা-বের কারণে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যানজটে নাকাল হয়ে পড়েন নগরবাসী। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মতিঝিল, জাতীয় প্রেসক্লাব, শাহবাগসহ আশপাশের প্রতিটি রাস্তায় তীব্র যানজট ছিল।
এ ব্যাপারে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে হয়েছে। সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন পুলিশ সদস্যসহ অনেকেই আহত হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম, ঢাকার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রফিকুল ইসলামসহ অন্তত ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।