ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

চালক, বাস মালিক ও বীমা কোম্পানিকে তিন মাসের মধ্যে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে

তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা দিতে হাইকোর্টের নির্দেশ॥ দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা দিতে হাইকোর্টের নির্দেশ॥ দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রখ্যাত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, চালক, বাস মালিক ও বীমা কোম্পানিকে তিন মাসের মধ্যে ওই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ রবিবার এই রায় ঘোষণা করেন। এর আগে বুধবার এ রায় ঘোষণা শুরু হয়। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন নিহত তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, তার আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন এবং রমজান আলী সিকদার। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুস সুবহান তরফদার। বীমা কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী। ক্যাথরিন মাসুদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন; রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত জাহান। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৮৯ সালে মিনিট্রাকের চাপায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু নিহত হওয়ার ঘটনায় ২০১০ সালে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ । ব্যারিস্টার সারা হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ক্ষতিপূরণের দাবি সকলের জন্য থাকা উচিত। এর মাধ্যমে অন্যরাও ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন। স্নেহ ভালবাসা থেকে কেউ যদি বঞ্চিত হয়, তা হলে সবার জন্য একই মাপকাঠিতে ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার থাকবে। রায়ে আদালত গাড়ির চালকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গাড়ির চালকদেরও ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিপূরণের দায় নিতে হবে। তা না হলে তারা সতর্ক হবেন না। এখন থেকে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে আহত কিংবা নিহতের পরিবার ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারবে। প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশে ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩’ নামে একটি আইন রয়েছে। কিন্তু ওই আইন সম্পর্কে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জানত না।’ আইনটি সম্পর্কে (মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩) না জানার কারণে তারা (ক্ষতিগ্রস্তরা) কখনও আদালতে আসেনি। তবে এই রায়ের পর থেকে ভবিষ্যতে তাদের আদালতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলো। এখন থেকে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির মুখোমুখি হলে আহত ব্যক্তি তার নিজের পক্ষে অথবা নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পরিবার এই আইনের অধীনে আদালতে আসতে পারবেন। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আগেও আদালতে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু জনগণ এখন এ সম্পর্কে জেনেই আদালতে আসতে পারবে।’ এর আগে গত ১৭ নবেম্বর মামলাটি শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য বুধবার দিন ঠিক করেছিলেন হাইকোর্ট। বুধবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিট থেকে রায় ঘোষণা শুরু করে রবিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে তা শেষ করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর আইনজীবী সারা হোসেন সাংবাদিকদের জানান, দীর্ঘ পাঁচ বছরের লড়াইয়ে আজ (রবিবার) সমাপ্তি টানা হলো। মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, ছেলে নিষাদ মাসুদ এবং মা নুরুন্নাহার বেগম এ মামলাটি করেছিলেন। রায়টি রবিবার পেয়েছি। রায়ে বলা হয়েছে, যারা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের এখন ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা দিতে হবে তারেক মাসুদের পরিবারকে। গাড়ির চালক দেবেন ৩০ লাখ, তৃতীয় পক্ষের ক্ষতির জন্য ইন্স্যুরেন্স মালিককে (রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স) দিতে হবে ৮০ হাজার টাকা এবং বাদ বাকি টাকা দেবেন বাস মালিকরা। এ টাকা দিতে হবে তিন মাসের মধ্যে। তিন বাস মালিককে সমান ভাগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক মালিককে দিতে হবে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৬৫ হাজার ১৫১ টাকা। তিনি আরও বলেন, এ টাকাটা চেয়েছিলাম কয়েকটা খাতে। সেগুলো হলো- তারেক মাসুদ মূল উপার্জনকারী ছিলেন, মৃত্যুর কারণে উপার্জন কমে গেছে। তার স্নেহ এবং ভালবাসা হারিয়েছে। ক্যাথরিন নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তার চোখের ক্ষতি হয়েছে। মাইক্রোবাসটি ড্যামেজ হয়ে গেছে। রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ক্যাথরিন মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এত দিনের যন্ত্রণার পর এ রায়টা পেয়ে কিছুটা হলেও সান্ত¦না পেয়েছি। আমি তারেককে ফেরত পাব না। তবে আজকে আমি কিছুটা সান্ত¦না পেয়েছি আমার সাত বছরের ছেলের জন্য, যে তার বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।’ ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাস আরোহী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মুক্তির গান ও মাটির ময়না চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তখন তার নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর শূটিং শুরুর কাজ করছিলেন। সাংবাদিকতার সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর তখন টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ‘কাগজের ফুল’ এর লোকেশন দেখতেই তারা মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন। তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল এবং মাইক্রোবাসের চালক মুস্তাফিজও নিহত হন ওই দুর্ঘটনায়। আহত হন ওই মাইক্রোবাসে থাকা তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেকের প্রোডাকশন ইউনিটের সহকারী সাইদুল ইসলামও। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। এরপর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা করেন। পরে সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে এ দুটি মামলা হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করা হয়। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের স্ত্রী কানিজ এফ কাজী ও ছেলে সুহৃদ মুনীরের ওই দুটি আবেদন করেন। পরে প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৩ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে মামলা দুটি কেন উচ্চ আদালতে বদলি করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি মামলা দুটির নথি তলব করা হয়। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলা ও মোটর ক্লেইমস ট্রাইব্যুনালে করা মামলা দুটি হাইকোর্টে বদলির আবেদন মঞ্জুর করে রায় দেন হাইকোর্ট। পরবর্তীতে বিচারপতি জিনাত আরার নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির জন্য পাঠান প্রধান বিচারপতির কাছে। ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ হাইকোর্টে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। সাক্ষ্যে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ মোট সাত কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা বলেন। আদালতে ক্যাথরিন মাসুদের পক্ষে ৭, বাস মালিক সমিতির পক্ষে ৫ ও রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে একজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ঘটনা বিরল। এর আগে ১৯৮৯ সালে মিনিট্রাকের চাপায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু নিহত হওয়ার ঘটনায় ২০১০ সালে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। তবে এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। মানিকগঞ্জের সেই দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী ও ছেলে সুহৃদ মুনীরের করা মামলাটি আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।
×