ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বীরপ্রতীক হাবিবুল আলমকে র‌্যাব অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, পরে মুক্তি ॥ তিনি ভিকটিম নাকি জড়িত খতিয়ে দেখছে র‌্যাব

প্রতারণার ফাঁদ আড়াই লাখ ইউরো হাতিয়ে নেয়ার ৩ আফ্রিকান আটক

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১১ নভেম্বর ২০১৭

প্রতারণার ফাঁদ আড়াই লাখ ইউরো হাতিয়ে নেয়ার ৩ আফ্রিকান আটক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রতারণার মাধ্যমে আড়াই লাখ ইউরো (আড়াই কোটি টাকা) হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তিন আফ্রিকানকে আটক করেছে র‌্যাব। আটকরা হলো কুয়েতি ফস্তো, এমিলিয়া মাওয়াবো ও হারমান মার্টিন। এদের মধ্যে দুজন ক্যামেরুনের নাগরিক, অন্যজন আফ্রিকান হলেও কোন্ দেশের তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রতারক চক্রটি ফার্মার্স ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে প্রতারিত করে আড়াই লাখ ইউরো হাতিয়ে নেয়। আটকদের কাছ থেকে ৬৮ লাখ টাকার সমপরিমাণ ইউরো, পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন, বিদেশী মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ প্রতারকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে বৃহস্পতিবার হাবিবুল আলম বীরপ্রতীককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নেয় র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে প্রতারকদের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক সে বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে জানান, জার্মানি থেকে ১১ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছিল। শুক্রবার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, বিদেশী বিশেষ করে আফ্রিকান প্রতারকরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রতারণা করে। এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করে এক ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের কাছ থেকে আড়াই লাখ ইউরো হাতিয়ে নিয়েছে। বড় বিনিয়োগের কথা বলে প্রথমে সম্পর্ক স্থাপন ও পরবর্তীতে ছোট ছোট লেনদেন করে এক সময় বড় টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয় তারা। ফার্মার্স ব্যাংক গুলশান শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার জিয়ার কাছে প্রথমে জার্মানি থেকে রোজার্স নামে একজন ফোন দিয়ে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে। সে জানায় বাংলাদেশে ১১ মিলিয়ন ইউরো ইনভেস্ট করতে চায়। তখন তার সঙ্গে আলোচনায় রাজি হন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। কিছুদিন পর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে রোজার্সের রেফারেন্সে স্টিভ নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন জিয়া। সেখানে কিভাবে বিনিয়োগ হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্টিভ দেখা করে ব্যবসা ও ইনভেস্টের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে একদিন সিঙ্গাপুর যাওয়ার নাম করে স্টিভ ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে চার হাজার ডলার ধার নেয় এবং কিছুদিনের মধ্যে তা পরিশোধ করে। বিশ্বস্ততা তৈরির পর ইউরোপে একটি কাজে স্টিভের আড়াই লাখ ইউরো লাগবে বলে ব্যাংক কর্মকর্তাকে জানানো হয়। বাংলাদেশে একজনের কাছে স্টিভের ডলার আছে। ওই ডলার এক্সচেঞ্জ করে ইউরো করতে হবে। আর সেটার পরিমাণ আড়াই লাখ ইউরো। এজন্য তিনি ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে সাহায্য চান। ভবিষ্যতে ১১ মিলিয়ন ইউরোর ইনভেস্ট, নতুন সম্পর্ক ও অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়ার লোভে সাহায্য করতে রাজি হন ব্যাংক কর্মকর্তা। এরই মধ্যে গত ৩১ আগস্ট ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ইউরো ম্যানেজ করে ব্যাংকে অপেক্ষা করেন। কিন্তু স্টিভ সেদিন আর ব্যাংকে না এসে রাতে ম্যানেজারের বাসায় ইউরো নিয়ে যেতে বলেন। কথামতো ব্যাংক কর্মকর্তা আড়াই লাখ ইউরো নিয়ে বাসায় যান। রাতে স্টিভ, আটক কুয়েতি ফস্তোরা ম্যানেজারের বাসায় যায়। রাতে খাবার খাওয়ার পর কুয়েতি ফস্তো ইচ্ছা করে একটি বোতল ভেঙ্গে ফেলে এবং বোতলে থাকা তরল কিছুটা ওই ব্যাংক কর্মকর্তার গায়ে ফেলেন। তখন ইউরোর ব্যাগ আফ্রিকানদের সামনে রেখে ব্যাংক কর্মকর্তা পরিষ্কার হতে ভেতরে চলে যান। ফিরে আসার পর আফ্রিকানরা জানায়, তারা ডলার আনতে পারেনি, আগামীকাল লেনদেন করবে। এই বলে তারা বেরিয়ে যায়। তখন তাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেন ব্যাংক কর্মকর্তা। পরদিন সকালে স্টিভকে ফোন করেন ব্যাংক কর্মকর্তা। ফোনের ওপাশ থেকে স্টিভ জানান, সে ঝামেলায় আছে, পুলিশ তাকে ফলো করছে, পরে কথা বলবে বলে ফোন বন্ধ করে দেয়। তখন ব্যাংক কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। বাসায় থাকা ইউরোর ব্যাগ খুলে দেখেন আড়াই লাখ ইউরো সমপরিমাণ বান্ডিল আছে কিন্তু সেখানে ইউরো নেই, আছে সাদা কাগজ। রাতে তিনি পরিষ্কার হওয়ার ফাঁকে আফ্রিকানরা আড়াই লাখ ইউরোর বান্ডিল হাতিয়ে নিয়ে সাদা কাগজের বান্ডিল ফেলে যায়। প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে র‌্যাবকে বিষয়টি জানানো হয়। পরে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে উত্তরা থেকে তিন প্রতারককে আটক করে। এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘আমরা তিনজনকে আটক করেছি। এর সঙ্গে আরও যারা জড়িত রয়েছে তাদের আটকের চেষ্টা চলছে। হাবিবুল আলম বীরপ্রতীককে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে র‌্যাব মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আমরা উনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। উনার দেয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তিনি ভিকটিম না প্রতারকদের সঙ্গে জড়িত তা এখনও বলা যাচ্ছে না। এদিকে হাবিবুলের বোন অধ্যাপক শাহিন আলম বলেন, দুপুর দেড়টার দিকে কয়েকজন র‌্যাব সদস্য তাকে (হাবিবুল) অফিস থেকে তুলে নিয়ে যায়। অনুসরণ করে দেখা যায়, হাবিবুলকে বহনকারী গাড়িটি উত্তরায় র‌্যাব-১ কার্যালয়ে ঢোকে। ওই ঘটনার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ না করায় আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। রমনা থানায় জিডির করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পুলিশ জানায়, হাবিবুল র‌্যাব-১ কার্যালয়ে আছেন। এ বিষয়ে র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাসেম বলেন, এক ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ক্যামেরুনের একটি প্রতারক চক্র। ওই ঘটনার তদন্তে ক্যামেরুনের তিন নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। পরে প্রতারকদের ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলমের কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিষয়টি তদন্তে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি (হাবিবুল) র‌্যাবকে জানিয়েছেন, আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের ওই প্রতারক চক্রটি তার সাড়ে ১১ হাজার ইউএস ডলার মেরে দিয়েছে। ওই টাকা উদ্ধারে তিনি গোপনে চেষ্টা করছেন। তবে হাবিবুল আলম নিজে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত নাকি নিজে প্রতারিত হচ্ছেন তা নিশ্চিত নই। নিশ্চিত হতেই তাকে র‌্যাব কার্যালয়ে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, হাবিবুল আলম একাত্তরে ঢাকায় অভিযান পরিচালনাকারী গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইনফর্মেশন সার্ভিস নেটওয়ার্ক লিমিটেডের (আইএসএন) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ইস্কাটনে নিজ অফিসেই তিনি ব্যবসা করছেন।
×