ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মা-ছেলেকে একাই খুন করে জনি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ নভেম্বর ২০১৭

মা-ছেলেকে একাই খুন করে জনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকার কাকরাইলে চাঞ্চল্যকর মা-ছেলেকে সরাসরি ছুরিকাঘাতে হত্যাকারী আল আমিন ওরফে জনি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। জনি হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এর আগে ডিবি পুলিশের হাতে জনির ছোট বোন অভিনেত্রী শারমিন আক্তার মুক্তা ও তার স্বামী আব্দুল করিম গ্রেফতার হয়ে ৬ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বক্তব্য মোতাবেক বাড়ি, গাড়ি ও জায়গাজমির ভাগ পাওয়ার সূত্র ধরেই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটে। এর নেপথ্যে রয়েছে আব্দুল করিম ও তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তা। প্রায় পাঁচ মাস আগে আব্দুল করিমের রাঙ্গামাটির বাগানবাড়িতে হত্যার পরিকল্পনা করে আব্দুল করিম ও শারমিন আক্তার মুক্তা। শাওন হত্যার টার্গেটে ছিল না। মাকে হত্যার সময় বাধা দেয়ায় সাক্ষীকে চিরতরে শেষ করে দিতেই শাওনকে হত্যা করে জনি। গত ১ নবেম্বর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কাকরাইলে রাজমনি প্রেক্ষাগৃহের কাছে ৭৯/১ নম্বর ছয়তলা বাড়ির পঞ্চম তলায় খুন হয় ব্যবসায়ী করিমের প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার (৫০) ও তার ছেলে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্র সাজ্জাদুল করিম শাওন (১৮)। ওইদিনই ব্যবসায়ী করিম ও তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তাকে আটক করে ৬ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। এ ব্যাপারে দায়েরকৃত মামলায় এ দু’জন ছাড়াও আল আমিন ওরফে জনি নামে ম্ক্তুার এক বড় ভাইকে আসামি করা হয়। শনিবার ভোরে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানা এলাকা থেকে জনিকে (৩৩) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব-৩ এর একটি দল। শনিবার বিকেলে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে হত্যার রহস্য সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, জনি হত্যার দায় স্বীকার করেছে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক জনি ঘটনার তিন দিন আগে নিউমার্কেট থেকে এগারো শ’ টাকায় একটি ধারালো ছুরি কিনে আনে। এরপর সেই ছুরি দিয়েই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়। ওইদিন বিকেলে জনি ওই বাড়িতে যায়। কলিং বেল টিপলে গৃহকর্মী রাশিদা দরজা খুলে দেন। রাশিদা আগ থেকেই জনিকে আব্দুল করিমের তৃতীয় স্ত্রীর বড় ভাই হিসেবে চেনেন। এজন্য রাশিদা দরজা খুলে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যান। জনি রান্নাঘরের দরজা বাইর থেকে আটকে দেয়। এরপর ধারালো ছুরি বের করে শামসুন্নাহারকে মারতে তার ঘরের দিকে যেতে থাকে। বিষয়টি শাওন দেখে ফেলে। সে বাধা দিলে প্রথমেই তাকে পর পর কয়েক বার ছুরিকাঘাত করে। এ সময় ধস্তাধস্তিতে জনির হাত কেটে যায়। এরপর শামসুন্নাহারের ঘরে ঢুকে তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। শামসুন্নাহার ঘরের মেঝেতে পড়ে মারা যায়। এরপর জনি আবার শাওনের খোঁজ করে। দেখে শাওন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। জনি দ্রুত শাওনের পিছু নেয়। শাওনকে ডাকতে থাকে। তাতে কান না দিয়ে শাওন দ্রুত নিচে নামার চেষ্টা করে। এ সময় জনি দৌড়ে গিয়ে শাওনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। শাওন দ্রুত পাঁচ তলা থেকে নেমে চারতলার সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে পারে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে এক পর্যায়ে শাওন চারতলার সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে যায়। সেখানেই শাওন মারা যায়। চিৎকার শুনে বাড়ির দারোয়ান নোমান দ্রুত উপরে উঠতে থাকে। এ সময় জনি দারোয়ানকে উপরে মারামারি লাগছে, দ্রুত সেখানে যেতে বলে। আর এই ফাঁকে জনি বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। চাকুটি সেখানেই ফেলে দেয়। এরপর বাড়ির কাছে আগ থেকেই ব্যাগে রাখা কাপড় পরে নেয়। আর রক্তমাখা কাপড়গুলো সেখানে লুকিয়ে রাখে। দ্রুত চলে যায় গোপালগঞ্জে। র‌্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, বোনের সঙ্গে আব্দুল করিমের বড় স্ত্রীর দীর্ঘ দিন ধরে বনিবনা হচ্ছিল না। বাড়ির সহায়সম্পত্তির অধিকাংশই বড় স্ত্রীর নামে। তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে মুক্তা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছিল। এমনকি স্ত্রী হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদা পাচ্ছিল না। এমনকি করিমের বাড়িতে থাকতে দিত না তার বড় স্ত্রী শামসুন্নাহার। অনেক যন্ত্রণা সহ্য করে মুক্তাকে থাকতে হচ্ছিল। একবার মুক্তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করায় বড় স্ত্রী। আবারও তারা মিলেমিশে বসবাস করছিল। কিন্তু আবারও ডিভোর্স করানোর চেষ্টা করছিল শামসুন্নাহার। এসব বিষয় নিয়ে নানা অশান্তির কারণে মুক্তা কয়েক দিন আগে পল্টনের বাসায় আত্মহত্যা করতে যায়। ওই সময় জনি ও আব্দুল করিম তাকে বাঁচায়। এমন নানা ঘটনার প্রেক্ষিতেই জনি শামসুন্নাহারকে হত্যার টার্গেট করেছিল। আর হত্যায় মদদ ছিল আব্দুল করিম ও মুক্তার। মামলার বাদী নিহত শামসুন্নাহারের বড় ভাই আশরাফ আলী জানান, তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদর জেলার ভিটিশীলমন্দি গ্রামে। আব্দুল করিমের বাড়িও মুন্সীগঞ্জ সদরের মুক্তারপুরের জোড়পুকুরপাড় গ্রামে। ২৮ বছর আগে তাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। শামসুন্নাহারের বড় ছেলে মশিউর করিম মুন্না (২৭) ৭ বছর ধরে লন্ডনে। মেজো ছেলে আশিকুর করিম অনিক (২৫) তিন মাস আগে কানাডায় চলে গেছে। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল করিমের বড় স্ত্রী খুবই রাগী। স্ত্রীর ওপর রাগ করে আব্দুল করিম ফরিদা নামের এক নারীকে বিয়ে করে। সেই ঘরে আকাশ (২০) নামে এক ছেলে রয়েছে। বড় স্ত্রীর অত্যাচারের কারণে সেই স্ত্রীকে প্রথমে পুরনো ঢাকায় এবং বর্তমানে উত্তরায় ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। সেখানেই ছেলে নিয়ে বসবাস করছেন ফরিদা। আব্দুল করিম প্রায় বারো হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। মাথায় করে সবজি বিক্রি করতেন। ঢাকায় ঝামেলার জমি কিনে তা মীমাংসা করে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে মরিচের ব্যবসা করে তিনি সবচেয়ে বেশি টাকা রোজগার করেছেন। টাকার গরমে তিনি সিনেমার পরিচালক ও প্রযোজক হন। নিহত ছোট ছেলে শাওন কথাচিত্র নামে প্রডাকশন হাউজ গড়ে তোলেন। বেশ কয়েকটি সিনেমা তৈরি করেন। আব্দুল করিমের প্রযোজিত ও পরিচালিত একটি সিনেমায় অভিনয় করতে এসে ২০১২ সালের দিকে পরিচয় হয় তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তার (২৫) সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম। তার পিতার নাম মৃত মজিবুর রহমান। মা আলেয়া বেগম। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানাধীন মালদিয়া গ্রামে। আর প্রেম থেকে অবৈধ শারীরিক মেলামেশা। স্বামীর অনৈতিক মেলামেশা এবং রাতে বাইরে থাকা পছন্দ করতেন না শামসুন্নাহার। কোন কোন রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হলে সোজা কাকরাইলের অফিসে চলে যেতেন। অফিসে নারীদের উপস্থিতি দেখে বহুবার অফিসে ও বাসায় ভাংচুর করেছেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এত কিছুর পরও আব্দুল করিম অনৈতিক সম্পর্ক থেকে সরেননি। তিনি মুক্তাকে তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে ২০১৩ সালে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে শামসুন্নাহারের সঙ্গে আব্দুল করিমের সম্পর্ক সাপে নেউলের পর্যায়ে চলে যায়। কোন কোন দিন শামসুন্নাহার ঘুমের মধ্যে স্বামীর গায়ে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতেন। এমন পরিস্থিতিতে আব্দুল করিম বাড়ি ফেরা একপ্রকার বন্ধ করে দেন। তৃতীয় স্ত্রীকে মাসিক ২২ হাজার টাকায় প্রথমে পল্টনে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেন। মুক্তা তার মা, ভাই জনি ও জনির ছেলেকে নিয়ে নয়াপল্টনের ৩৬/১ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় বসবাস করছিলেন। দিনের বেলায় এ বাসায় সময় কাটাতেন আব্দুল করিম। আর রাতে বাসায় ফিরতেন। আব্দুল করিমের অধিকাংশ সহায়সম্পত্তি বড় স্ত্রীর নামে। এ নিয়ে তৃতীয় স্ত্রী খুবই অসন্তুষ্ট। মুক্তা স্ত্রী হিসেবে বড় স্ত্রীর মতো স্বামীর সহায়সম্পত্তির ভাগ দাবি করেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে আব্দুল করিমকে তার বড় স্ত্রী মুক্তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করায়। ডিভোর্স লেটার পাওয়ার পর আব্দুল করিমকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আব্দুল করিম মুক্তাকে জানায় বড় স্ত্রীর চাপের কারণে এটি করতে হয়েছে। তবে সম্পর্ক টিকে থাকবে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তা শামসুন্নাহারকে একবার মারতে গিয়েছিল। ওই সময় বঁটি নিয়ে শামসুন্নাহার মুক্তাকে ধাওয়া করেছিল। এ ব্যাপারে রমনা থানায় ২০১৬ সালে একটি সাধারণ ডায়েরিও হয়। এত কিছুর পরেও যথারীতি আব্দুল করিম ও মুক্তা আগের মতোই মেলামেশা করছিল। এ খবর বড় স্ত্রী জানতে পারে। এজন্য তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে ডাকাতির নাটক সাজানোর পরিকল্পনা করে। পাঁচ মাস আগে আব্দুল করিম ও মুক্তা রাঙ্গামাটিতে আব্দুল করিমের বাগানবাড়িতে যায়। সেখানে বড় স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার পর ডাকাতির নাটক সাজানোর ছক কষে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মেজো ছেলেকে কানাডা পাঠিয়ে দেয় আব্দুল করিম। আর ছোট ছেলেকে সব সময় পড়াশোনা আর কোচিংয়ে ব্যস্ত রাখত। যাতে স্ত্রীকে হত্যা করতে কোন অসুবিধা না হয়। হত্যাকারী হিসেবে মুক্তা তার নিজের বড় ভাই জনিকে নির্বাচিত করে। কারণ, বিষয়টি ভাই কোনদিনই প্রকাশ করবে না। জনি মূলত ভবঘুরে। কোন কাজকর্ম নেই। বিয়ে করেছিল। সেই ঘরে একটি ছেলে রয়েছে। ছেলেটিকে মুক্তা লালনপালন করে। জনি মাদকাসক্ত। জনিও বোনের কষ্ট দেখে মানসিকভাবে শামসুন্নাহারকে হত্যার পক্ষে বিভিন্ন সময় মত দিয়েছে। সর্বশেষ আত্মহত্যার চেষ্টার পর জনি শামসুন্নাহারকে মারতে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের মতো ওই দিনও বাসায় গৃহকর্মী আর শামসুন্নাহারের থাকার কথা ছিল। কিন্তু ওই দিন কোচিং না থাকায় ছেলে বাসায় ছিল। আর ঘটনাচক্রে শাওনকে বলি হতে হয়েছে।
×