ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নেই কোন পদক্ষেপ

জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে ই-বর্জ্য

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে ই-বর্জ্য

সমুদ্র হক ॥ প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এক সময় নষ্ট হয়ে যায়। বিক্রি করা হয় পরিত্যক্ত জিনিসের ভ্রাম্যমাণ ক্রেতাদের কাছে। কখনও ফেলে দেয়া হয় বাড়ির বাইরে। কখনও বছরের পর বছর পড়ে থাকে পণ্য মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান ও ভাঙ্গারির দোকানে। এসব বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট কোন ডাস্টবিন কিংবা ভাগাড় নেই। দিনে দিনে দেশের প্রতিটি এলাকায় এই বর্জ্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বর্জ্যরে নামকরণ হয়েছে ই-ওয়েস্ট বা ই-বর্জ্য। বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ ও সুধীজন বলছেন, এই বর্জ্য একবিংশ শতকে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। ই-বর্জ্য হলো বাতিল ও পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার, বিদ্যুত সাশ্রয়ী বাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, এয়ার কন্ডিশনার, ওভেন, টোস্টার ইত্যাদি। দেশে সেল বা মোবাইল ফোন (মুঠোফোন) ব্যবহারকারীর সংখ্যা অন্তত ১০ কোটি। তাদের অনেকের কাছে একাধিক সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিটি মডিউল (সিম কার্ড) আছে। এজন্য অনেকেই ব্যবহার করেন একাধিক সেট। কেউ বেশি কথা বলার জন্য ব্যবহার করেন একটি সাধারণ মানের সেট। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ভাল কোন এ্যান্ড্রয়েড বা আই ফোন সেট ব্যবহার করেন। মোবাইল ফোন সেট ব্যবসায়ী সমিতির এক তথ্যে বলা হয়, প্রতি বছর মোবাইল ফোন সেট আমদানি হচ্ছে অন্তত তিন কোটি পিস। এর বাইরে অবৈধ পথে আসছে ৫০ লাখেরও বেশি। সাধারণ মনের ফোন সেটগুলোর আয়ুষ্কাল বেশি নয়। স্মার্ট ফোনগুলোর (এ্যান্ড্রয়েড ও আই ফোন) মধ্যেও ব্র্যান্ড কোম্পানি ছাড়াও অন্যগুলো বেশি দিন টেকসই হচ্ছে না। এই ফোন সেটগুলো এক সময় ই-বর্জ্য হয়ে যায়। ফেলে দেয়া হয় ঘরের বাইরে। বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে দেশে ইলেকট্রনিকস পণ্য টিভি ফ্রিজ কম্পিউটার ও অন্যান্য সামগ্রী রফতানি করে। দেশে এসব পণ্যকেও আর বিশ্বাস করার উপায় থাকছে না। একাধিক সূত্র থেকে যা মিলেছে তা এ রকম- এক ধরনের চতুর ব্যবসায়ী বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ‘এ্যাকসেসরিজ’ বাইরে থেকে কিনে এনে দেশের মধ্যে এ্যাসেম্বেল করে ব্র্যান্ড কোম্পানির নামে বিক্রি করে। কখনও মনগড়া নাম দেয়। ক্রেতারা সহজেই প্রতারিত হয়ে কম দামে এসব পণ্য কেনে। ওইসব পণ্যের মডেল নম্বর দেখে ব্র্যান্ড কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায় ওই মডেলের কোন পণ্য তাদের নেই। বিষয়টি সাধারণ ক্রেতার পক্ষে বোঝা খুব কঠিন। তারা এসব পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। দেখা যায়, কিছুদিন ব্যবহারের পর তা অকেজো হয়ে পড়ছে। মেরামতকারীদের কাছে নিয়ে গেলে তারা এক পার্টস খুলে আরেক পার্টস লাগিয়ে দিয়ে যেমন তেমন করে তা সারিয়ে দিচ্ছেন। এই পার্টসগুলো একসময় ই-বর্জ্য হচ্ছে। আরেকদিকে ইলেকট্রনিক্স পণ্যটি এক সময় ভাঙ্গারি মালের দোকানে যাচ্ছে। পরিবেশবিদগণ বলছেন, এসব ই-বর্জ্যে থাকে ক্ষতিকর ও বিষাক্ত ধাতু, নানা ধরনের রাসায়নিক যৌগ, সিসা, সিলিকন, টিন, রেজিন ফাইবার, ক্যাডমিয়াম, মারকারি, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড, এক ধরনের গ্যাস ইত্যাদি। ফেলে দেয়া ই-বর্জ্যরে মধ্যে অনেক বিষাক্ত পদার্থ ও রাসায়নিক যৌগ আছে যা রোদে ও তাপে নানাভাবে বিক্রিয়া করে। অনেক সময় রোদে ফেলে দেয়া ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) থেকে নির্গত হয় ক্ষতিকর বিকিরণ। এই ই-বর্জ্য পানিতে ফেলে দিলে ও মাটিতে পুঁতে রেখে দেয়ার পরও বিষাক্ত থাবা বন্ধ থাকে না। পলিব্যাগ যেমন মাটির নিচেও বিক্রিয়া করে এসব ই-বর্জ্য তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে হয়ে বিক্রিয়া করে। যা মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বিপজ্জনক। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই ই-বর্জ্যরে প্লাস্টিকের অংশটি আলাদা করে রিসাইক্লিং করছে। বাকি বর্জ্য বিশেষায়িত ভাগাড়ে ফেলে দিচ্ছে। তাছাড়া উন্নত বিশ্বে কোন ইলেকট্রনিক্স পণ্য সামান্য নষ্ট হলে বাড়ির বাইরে কোন নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে রাখে। তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর লোকজন তা সংগ্রহ করে তাদের দেশে পাঠায়। এভাবেও উন্নত বিশ্বের লোকজন ই-বর্জ্য কৌশলে পার করে দিচ্ছে। কিছু ফেলা হচ্ছে মহাসাগরের ভেতরে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। ই-বর্জ্য নিয়ে সরকারী-বেসরকারী কোন সংস্থারই মাথাব্যথা নেই। নেই কোন পদক্ষেপও। একজন পরিবেশবিদ বলেন, ইলেকট্রনিক্স কিছু পণ্যের মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন (সিএফসি) পাওয়া যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট নিরাময়ের ইনহেলারেও সিএফসি মিলছে। পণ্যে সিএফসি ব্যবহার নিষেধ। পণ্যটি ই-বর্জ্যে পরিণত হলে পরোক্ষভাবেও এই সিএফসি কাজ করে। এটা এক ধরনের গ্যাস। ই-বর্জ্যে কত ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ আছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এভাবে এর হিসাব হয় না। তারপরও বলা যায়, এ সংখ্যা অন্তত এক হাজার। ইনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০১১-১২ সালে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ৫১ লাখ মে. টন। পরবর্তী বছরেই তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় এক কোটি ১০ লাখ টনে। বর্তমানে এই পরিমাণ অন্তত আট লাখ টন। যার বেশিরভাগই আসছে মোবাইল ফোন ও ট্যাব থেকে। এই পরিমাণ বর্জ্য সারাদেশের কোন না কোন জনবহুল স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। নগরী ও জেলা শহরগুলোরে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মেরামতকারীদের দোকানে ও ভাঙ্গারির দোকানে গেলে দেখা ই-বর্জ্য স্তূপ হয়ে আছে। দিনে দিনে ই-বর্জ্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।
×