ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কট ভিন্ন খাতে নিতে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কট ভিন্ন খাতে নিতে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে মিয়ানমার

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা গণহত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন নিয়ে বিশ্বজুড়ে চাপের মুখে সেখানের প্রকৃত ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে অপকৌশল নিয়েছে মিয়ানমার। দেশ-বিদেশের কূটনীতিকদের মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সরবরাহ করে বিভ্রান্তির চেষ্টা করছে তারা। বিশেষ করে মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যা ও নির্যাতন বিষয়টি চেপে রেখে সেখানের সন্ত্রাস ও উগ্রবাদী তৎপরতা রয়েছে এমন প্রচার করছে দেশটি। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ঘিরেও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে মিয়ানমার। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানায়। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পড়েছে এখন মিয়ানমার। বিশেষ করে জাতিসংঘ, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা থেকে প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে মিয়ানমারের ওপর। সে কারণে দেশটি রোহিঙ্গা সঙ্কট ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইছে। মিয়ানমারে অবস্থানকারী বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করছে। বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনেও মিয়ানমার মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সরবরাহ করে চলেছে। জাতিসংঘের এবারের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে উত্তাপ ছড়াবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরবেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও মিয়ানমারের গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধে বক্তব্য রাখবেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের কয়েক রাষ্ট্রপ্রধান সেটা ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে এই পরিস্থিতি এড়াতে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি এবার জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কৌশল নিয়েছে। গত বছর সাধারণ অধিবেশনে গেলেও তিনি এবার সেখানে যাবেন না। সুচির না যাওয়ার পেছনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি যেতে পারছেন না। এছাড়া সেদেশে সম্ভাব্য আরও হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করে সুচি জাতিসংঘ অধিবেশনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘের চাপ এড়াতেই সুচি এবার সেখানে যাচ্ছেন না। এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মিয়ানমার যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম ইস্যু হলো উগ্র ও সন্ত্রাসবাদ। মিয়ানমার উগ্র ও সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতাকেই সামনে তুলে আনছে। সেখানকার গণহত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, রাখাইন থেকে বিতাড়ন ইত্যাদি ইস্যুকে আড়াল করতে চাইছে। এছাড়া বাংলাদেশে সম্প্রতি চার লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক প্রবেশ করলেও তারা দাবি করছেন, এরা সকলেই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালী। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় বলেও অপপ্রচার করছে দেশটি। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মিয়ানমার মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে মাত্র দুই হাজার মিয়ানমারের নাগরিক অবস্থান করছেন। সূত্র জানায়, রাখাইনের জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যু সামনে এনে মিয়ানমারের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সামনে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যু তুলে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে আসছে দেশটি। তবে সেখানে যে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর গণহত্যা ও নির্যাতন চলছে সে বিষয়ে দেশটি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশী কূটনীতিকদের সামনেও বিষয়টি তারা অস্বীকার করে আসছে। ওয়াশিংটনের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মিয়ানমারের ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। মিয়ানমারের কূটনীতিকরা প্রকৃত ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সরবরাহ করছে। গত বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরে যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফির সঙ্গে মিয়ানমারের ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত বৈঠক করতে গেলে রোহিঙ্গা নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সরবরাহ করেন। রাখাইনে কোন গণহত্যা চলছে না বলেও দাবি করেন তিনি। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফি শনিবার মিয়ানমার সফরে গেছেন। সেখানে তিনি রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে আলোচনা করবেন। প্যাট্রিক মার্ফি রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শন করতে চেয়েছেন। তবে রাখাইনের প্রকৃত ঘটনা আড়ালের জন্য প্যাট্রিক মার্ফিকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় যেতে দেবে না মিয়ানমার। প্যাট্রিক মার্ফি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সরকারী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত ও মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে সুচির ভাষণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন। রাখাইন রাজ্যের রাজধানী শিডউয়েও সফর করতে পারবেন প্যাট্রিক মার্ফি। তবে রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু জেলা পরিদর্শনের অনুমতি দেবে না মিয়ানমার। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের সমর্থনে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। উভয় দেশকেই মিয়ানমার রাখাইনের উগ্রবাদী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নেতিবাচক তৎপরতা তুলে ধরেছে। আর এই জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদীর তৎপরতা তুলে ধরে দেশ দুইটির একচেটিয়া সমর্থন আদায় করতে চায় মিয়ানমার। তবে ভারত ও চীনের কাছে আরসা নেতিবাচক তৎপরতা তুলে ধরলেও সেখানে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিষয়ে কোন তথ্য দেয়নি মিয়ানমার। একারণেই জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সমর্থন পেয়েছে। সূত্র জানায়, জাতিসংঘের কোফি আনান কমিশন ও রাখাইন রাজ্য বিষয়ক জাতীয় তদন্ত কমিশন বাস্তবায়নে একটি ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মিয়ানমার। তবে এই দুই কমিশনের প্রতিবেদন পরস্পরবিরোধী। কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হলেও রাখাইন রাজ্য বিষয়ক জাতীয় কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মিয়ানমারের সাবেক জেনারেল মিন্ট সোয়ের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। পরস্পরবিরোধী এই দুই কমিশন বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে ছবি এসেছে, তা অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি দেয়া হয়েছে, সেটা মিথ্যা ও বানোয়াট। অন্য স্থানের ছবি ব্যবহার করে মিয়ানমারের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে বলেও এমন মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করেছে মিয়ানমার। উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতন চলছে। প্রাণভয়ে এই পর্যন্ত চার লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। এর আগে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের অনুপ্রবেশ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
×