ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বালু উত্তোলন থামছে না

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বালু উত্তোলন থামছে না

ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল ॥ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ভূঞাপুর ও কালিহাতীতে সিন্ডিকেট তৈরি করে যমুনা নদী থেকে আবারও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জলদস্যুদের সহায়তায় ড্রেজায় দিয়ে বালু উত্তোলন করলেও স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের বৃহত্তর স্থাপনা বঙ্গবন্ধু সেতু। এছাড়া কয়েকটি গ্রামের আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চরম ঝুঁঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি বন্যার ধকল থাকতেই অবৈধ বালু উত্তোলন এলাকাবাসীর কাছে বাড়তি আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, বালু মহালের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যমুনায় ইতোপূর্বে জোড়া খুন, এলাকাভিত্তিক নানা দ্বন্দ্ব-কোন্দল, হামলা, মামলা ও সংঘর্ষের কারণে যমুনা নদীর ভূঞাপুর অংশে দীর্ঘদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। এর আগে পুলিশের সঙ্গে তাদের কয়েকবার গুলির ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি কয়েকজন জলদস্যু মারাও গেছে। তারপরও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম। যিনি জলদস্যুদের কব্জা করতে পারবেন, তিনিই হবেন বালু মহালের রাজা। অবৈধ বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে নদীতে ক্রমেই বেড়ে চলছে অপরাধ প্রবণতা। অভিযোগ রয়েছে, বালু মহাল থেকে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ চলে যাচ্ছে প্রশাসন ও জলদস্যুদের হাতে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করার অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড় ভূঞাপুর উপজেলার পাথাইলকান্দি থেকে গোবিন্দাসী ইউনিয়নের জিগাতলা পর্যন্ত ১৯টি স্থানে ফের অবৈধ বালু উত্তোলন শুরু করা হয়েছে। ভূঞাপুরের বাগানবাড়ী, সিরাজকান্দি, ল্যাংড়ার বাজার, বাঘবাড়ি, পুনর্বাসন, মাটিকাটা, চিতুলিয়াপাড়া, পলশিয়া, সারপলশিয়া, গোবিন্দাসী ও নদী তীরবর্তী কয়েকটি ঘাটে বাংলা ড্রেজারসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার বালু কেনাবেচায় প্রতিদিন কাজ করছেন হাজারো শ্রমিক। এছাড়া চলাচল করছে বালুবাহী শতশত ট্রাক। যমুনা নদী থেকে অসংখ্য ড্রেজার ও বলগেট দিয়ে উত্তোলিত বালু বিক্রির জন্য ঘাটে জমা করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিকরাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিন সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতা স্থানীয় দুলাল চকদারের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট করে এসব বালুঘাট পরিচালনা করা হচ্ছে। ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় মাসুদ মেম্বার, নুহু মিয়া, করিম মেম্বার, আহাদ আলী, আমিনুল ইসলাম আমিন, সাদ্দাম হোসেন, হাশেম প্রামাণিক ও কালাম মেম্বারসহ ২৫-২৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি গত এক সপ্তাহ ধরে পুনরায় বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। বর্তমানে ইউপি চেয়ারম্যান মতিন সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল চকদার বালু মহলের একচ্ছত্র অধিপতি। তাদের বালু সাম্রাজ্যে কেউ মুখ খুললেই মামলা-হামলার শিকার হতে হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তরাংশ থেকে গোবিন্দাসী পর্যন্ত সকল বাঁধ (ডাব) ইজারা বন্ধ করে ট্রাক চলাচলে গত বছর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে সাময়িকভাবে হলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ওইসব ডাব বা রাস্তা অবৈধভাবে ব্যবহার করে অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু ট্রাক দিয়ে দিনরাত সরবরাহ করছেন। যমুনায় বালু উত্তোলনের ফলে নদীপথ পরিবর্তিত হয়ে জাতীয় স্থাপনা বঙ্গবন্ধু সেতু হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয়রা জানায়, নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ হওয়ায় তারা পারিপার্শ্বিক কারণেই অসহায়ভাবে জীবনযাপন করে আসছেন। নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতিবছরই তাদের আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙনের শিকার হয়। ভূঞাপুরের বালু ব্যবসায়ীরা সিরাজগঞ্জ থেকে বালু কিনে এনে বিক্রি করার কথা বলে প্রশাসনকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। মূলত সিরাজগঞ্জের বালু সিরাজগঞ্জ থেকেই বিক্রি হবে এটাই স্বাভাবিক। ভূঞাপুরের বালুই ভূঞাপুর থেকে বিক্রি করা হয়। নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, ভূঞাপুর উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ এবং জলদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত করে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভূঞাপুর অংশের প্রভাবশালীরা নতুন করে বালু ব্যবসা শুরু করেছেন। বালু উত্তোলনের কারণে এলাকায় প্রতিবারই ভাঙন দেখা দিচ্ছে। বালু বিক্রেতারা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। বিবিএ বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড় সাইট অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী প্রকৌশলী ওয়াসিম আলী জানান, যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে তাদের কেউ জড়িত নন। তবে বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য উত্তোলনকারীদের নোটিস দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক খান মোঃ নূরুল আমীন জানান, বালু উত্তোলনের সঙ্গে অনেক রুই, কাতলা, রাঘববোয়াল জড়িত। তবে আমাদের জাতীয় সম্পদ বঙ্গবন্ধু সেতু রক্ষায় যা কিছু করা দরকার, তা-ই করব। টাঙ্গাইলে সরকারী সংস্থা কিংবা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ছাড়া কাউকে আর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে এক ইউপি চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়েছে। ভূঞাপুর অংশে পাশের জেলা সিরাজগঞ্জ থেকে বালু কিনে এনে স্তূপ করে রেখে তা বিক্রি করা হয় বলে তাকে জানানো হয়েছে। ভূঞাপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এমন খবর তার (ডিসি) কাছে নেই। তাছাড়া কেউ অভিযোগও করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×