ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইন সীমান্তে মিয়ানমারের ॥ সেনা মোতায়েন

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাখাইন সীমান্তে মিয়ানমারের ॥ সেনা মোতায়েন

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সীমান্ত এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমার সরকার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রুর ওপারে সেনা মোতায়েন করেছে। শনিবার বিকেলে সীমান্তের এপার থেকে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর টহল দেখা গেছে। এ সংখ্যা প্রায় দেড় শ’ বলে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার সূত্রগুলো দাবি করেছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায়। সেনা টহল দেখে তাদের মাঝে নতুন করে শঙ্কা দানা বেঁধেছে। সেনা টহলের পাশাপাশি সে দেশের বিজিপি টহলও জোরদার রয়েছে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো বলেছে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে ওপথ দিয়ে পুনরায় সে দেশে ফিরে যেতে না পারে এ জন্যই বিজিপির পাশাপাশি নাসাকা সদস্যদের মোতায়েনের এ ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশ বডার গার্ড (বিজিবি) কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। কেননা, যে কোন সীমান্তের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে সেনা টহল ও মোতায়েন নিষিদ্ধ করা আছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন সূত্রে ধারণা করা হচ্ছে, সীমান্তের সব পয়েন্টে অনুরূপভাবে ধাপে ধাপে নাসাকা বাহিনী মোতায়েন হবে। এর মূল লক্ষ্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে আর নিজ দেশে ঢুকে যেতে না পারে। আগেই আউং সান সুচির দফতর থেকে বলা হয়েছে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র বা সে দেশে অবস্থান করে আসছে এমন কোন প্রমাণ না থাকলে কোন রোহিঙ্গাকে সে দেশে ঢুকতে দেয়া হবে না। এদিকে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে নাগরিকত্বের কার্ড ছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের প্রমাণপত্র রয়েছে। কিন্তু ফেরত প্রক্রিয়া নিয়ে দুদেশের যতদিন পর্যন্ত আলোচনা হয়ে সিদ্ধান্ত না হবে ততদিন পর্যন্ত ফিরে যেতে আগ্রহীদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী। আবারও বর্বরতার ভয়ে অনেকে এদেশে আশ্রিত হয়ে থাকতেও আগ্রহী। আবার অনেকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড সরকার আশ্রয় দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে সে সুযোগ নিতেও আগ্রহী। এদিকে রোহিঙ্গাদের আর শেষ রক্ষা হচ্ছে না। মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক জান্তার নেতৃত্বে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনায় মানবতার কবর যে রচিত হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই। রাখাইনের উত্তর মংডু, বুচিদং, রাচিদং শহর এলাকার সর্বত্র সেনা আগ্রাসনে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হওয়ার পর বর্তমানে যেন মৃত্যুপুরী। বিশ্বের শক্তিশালী এবং অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশ ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করে নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাতের যে নীলনক্সা রচনা করেছে তা এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে। এ পর্যন্ত চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশু প্রাণ নিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে বুলেটবিদ্ধ, বেয়নেট খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত এবং স্থলমাইন বিস্ফোরণে হাত-পা উড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশুর সংখ্যা দুই শতাধিক। যার মধ্যে ৮৫ জন ভর্তি হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অন্যরা চিকিৎসা নিচ্ছে কক্সবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। এদিকে খোদ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রাখাইন রাজ্যে সেনা নেতৃত্বাধীন অভিযানে রোহিঙ্গাদের মৃতের সংখ্যা সহস্রাধিক। আসলে এ সংখ্যা আরও বেশি, যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। রাখাইন রাজ্যের এমন কোন রোহিঙ্গা পরিবার নেই যাদের এক বা একাধিক সদস্য সেনা বর্বরতায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেনি। এছাড়া আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা সেখানকার পাহাড়-পর্বত ও ঝোপ জঙ্গলে এবং বিভিন্ন বসতিতে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এদের যখন তখন নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। সামরিক জান্তার হিংস্র ছোবল নির্মমতার শেষ বলতে যা বুঝায় সেটিও অতিক্রম করেছে। ফলে লাখে লাখে রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন পয়েন্ট ও সাগর পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেই চলেছে। এ অবস্থায় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড দেশান্তরিদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় মানব পাচারকারী চক্র নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকনাফ সীমান্ত এলাকার একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগের মতোই মানব পাচারকারী চক্র রোহিঙ্গাদের বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য উৎসাহ যোগাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের মাঝে অসচেতনতার কারণে লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্গম উত্তাল সাগরের ঢেউ অতিক্রম করার বাসনা জেগেছে। ইতোপূর্বে এ দুর্গম পথে হাজার হাজার রোহিঙ্গার সলিল সমাধির ঘটনাবলী তারা হয়ত মনে রাখেনি। অথবা এ পথে পা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। আর দালাল চক্র জনপ্রতি যেভাবে পারে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। তবে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনই সুনির্দিষ্টভাবে এমন খবর পাওয়া যায়নি বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সূত্রগুলো রাতের আঁধারে এ চক্রের তৎপরতা লক্ষণীয় বলে জানাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যা ও লোমহর্ষক অভিযানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে এশিয়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোকে জরুরী ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারতের তামিলনাড়ুতে শনিবার মিয়ানমার সরকারের রক্তাক্ত অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান, জাপান, ফিলিপিন্স, চেচনিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি থাইল্যান্ডেও বিক্ষোভ হয়েছে। মালয়েশিয়ার পক্ষে শনিবার রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করা হয়েছে। এর আগে ইরানের পক্ষ থেকে সাহায্য প্রেরণের ঘোষণা এসেছে। শনিবার ডেনমার্ক সরকারও রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলের উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সেবা চালিয়ে যাচ্ছে ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা। বাংলাদেশও সরকারীভাবে রোহিঙ্গাদের সার্বিক সহায়তায় পুর্ণোদ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গার সংখ্যা এতই বেশি যে তা বাংলাদেশের একার পক্ষে সামাল দেয়া অসম্ভব বলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন দাবি করেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী, আশ্রিত, নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটি স্থানে জরুরী ভিত্তিতে যে নলকূপ বসানো হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই সামান্য। ফলে প্রায় ২৫টি পাহাড়-জঙ্গলে অসুস্থ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ এখন চরমে। উখিয়া-টেকনাফের রাস্তার দু’ধারে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় এবং সুপেয় পানির অভাবে পানিবাহিত রোগ মহামারী রূপ নিতে পারে বলে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতদের পক্ষে শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে জরুরী সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে কখনও সম্ভব যে নয় তা স্পষ্ট। কক্সবাজারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া-টেকনাফে তিনটি জোন করা হয়েছে। বিজিবি কর্মকর্তা লে. কর্নেল মঞ্জুরুল আহসান খানও অনুরূপ তথ্য দিয়েছেন। এদিকে বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যানুযায়ী, আগে আসা এবং গত পনের দিনে নতুন করে আশ্রিত ও শরণার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এদের জন্য বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তার ঘোষণা দেয়া হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এরপরও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যাতে অনাহারে অর্ধাহারে বা বিনা চিকিৎসায় কোন রোহিঙ্গার মৃত্যু না হয়। মোট কথা মিয়ানমার সরকার যে চরম অমানবিকতা চালিয়েছে তার বিপরীতে বাংলাদেশ মানবিকতার সর্বোচ্চ পথ বেছে নিয়েছে। অপরদিকে জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা বিষয়ে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে আপাতত তাদের দায়িত্ব পালন করেছে বলে প্রতীয়মান। কিন্তু মিয়ানমারের রক্তাক্ত অভিযান বন্ধের ব্যাপারে কার্যকর কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। যার ফলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অদমনীয় মনোভাবে রোহিঙ্গা নিধন অব্যাহত রেখেছে। শনিবার মিয়ানমারের সংবাদকর্মীদের একটি দলকে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে নেয়া হয়। ওইসব সংবাদকর্মীও রাখাইন রাজ্যের তা-বলীলা দেখে বিস্মিত হয়েছেন। ইয়াঙ্গুন বা নেপিডো থেকে সাধারণ মানুষ যা চিন্তাও করতে পারছে না। কিভাবে একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। গণহারে অসহায় রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ প্রকাশে সে দেশের সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা ক্রমাগতভাবে প্রকাশ হচ্ছে। ফলে বিশ্ব বিবেক ইতোপূর্বেকার তুলনায় এখন কিছুটা সোচ্চার হয়েছে। মিয়ানমার সরকার বিশেষ করে নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ আসছে। কিন্তু সামরিক জান্তার হাতের পুতুল বলে খ্যাতি লাভকারী আউং সান সুচি এখনও বিষয়টি জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় কোন সন্ত্রাস নয় বলে উল্লেখ করে এটি বাঙালী সন্ত্রাসী বা জঙ্গী দমন অভিযান বলেই মত ব্যক্ত করে যাচ্ছেন, যা মানবতার প্রতি চরম উপহাস ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না বলে বিশ্ব গণমাধ্যমে মত ব্যক্ত করা হচ্ছে। টেকনাফে গুলিবিদ্ধ চার রোহিঙ্গা ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে টেকনাফ সীমান্ত থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শিশুসহ চার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। শুক্রবার রাত ১২টায় টেকনাফ পয়েন্ট থেকে তাদের উদ্ধারের পর স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক শুভন দাস বলেন, চার রোহিঙ্গার হাত-পা ও বুকে গুলির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গুলিবিদ্ধরা হলোÑ আব্দুল করিম, ইমান শরিফ, আমেনা খাতুন ও শিশু মোঃ সোহেল। গুলিবিদ্ধরা মিয়ানমারের তুবাপাড়ার বাসিন্দা বলে জানায় তারা। ১৭ পয়েন্টে শুরু হচ্ছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির নিবন্ধন ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে ১৭টি পয়েন্টে শুরু হচ্ছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির নিবন্ধন। প্রাথমিকভাবে পাসপোর্ট অফিসের সহায়তায় এই নিবন্ধনের কার্যক্রম চালানো হবে। এছাড়া রোহিঙ্গা বিষয়ক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানান, রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। ২০১৬ সালের শুরু থেকে যেসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা হবে। এজন্য ১৭টি পয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। এসব পয়েন্টে তাদের ডিজিটাল নিবন্ধন করা হবে। এজন্য স্বেচ্ছাসেবকও নেয়া হবে। রাস্তায় থাকা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের ভেতর নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। ৫১৭ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যের অনুপ্রবেশ ॥ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গাদের। বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি চঞ্চল দাশ গুপ্ত জানিয়েছেন, শুক্রবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আরও ২০ হিন্দু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে কুতুপালং পশ্চিম হিন্দু পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৫১৭ সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ইতোপূর্বে আর কখনও হিন্দুদের পালিয়ে আসার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এবার সে দেশের সামরিক জান্তা রাখাইন রাজ্য থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিধনে নেমে হিন্দু পরিবারগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না। আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহে প্রশাসন হিমশিম ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ঢল অব্যাহত থাকায় মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহে স্থানীয় প্রশাসন রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। যদিও গত শুক্রবার ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার পাশাপাশি তাদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হবে। বাংলাদেশের আহবানে বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে সাড়া দিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছতে শুরু করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যারা যাচ্ছে তারা কোনভাবেই চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে সরবরাহকারী দলের সদস্যদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখা কঠিন ॥ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের উখিয়া-কুতুপালংয়ের মধ্যবর্তী স্থানে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে কক্সবাজার প্রশাসন কাজ শুরু করলেও তা একটি কঠিনসাধ্য ব্যাপার। কেননা, মিয়ানমার সীমান্ত থেকে জলে স্থলে বিভিন্ন পয়েন্টে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের যে ঢল নেমেছে তাদের এক করে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এক স্থানে জড়ো করে রাখা রীতিমতো দুঃসাধ্য। এছাড়া ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ছাড়াও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেছে। তবে বিশাল অংশটি এখনও সীমান্ত পয়েন্টের বাংলাদেশী এলাকাগুলোতে রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন এরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরমুখী হচ্ছে। রোহিঙ্গা স্রোতে কক্সবাজার টেকনাফ সড়কে যেন ঢল সৃষ্টি হয়েছে। এ ঢল রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুদের যে যেভাবে পারে শহরমুখী যানবাহনে উঠে যাচ্ছে। তবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানিয়েছেন, আমরা সব রোহিঙ্গাকে বালুখালীতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। সবাইকে বিচ্ছিন্নভাবে না থেকে সব রোহিঙ্গাকে বালুখালীতে এসে নাম নিবন্ধনের জন্যও তিনি আহ্বান জানান। সেখানে সবার ছবিসহ নাম নিবন্ধনের কাজ চলছে বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার পৌর এলাকাসহ শহরতলীর আশপাশে অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পূর্ব পরিচিত বা নিকট আত্মীয়-স্বজনের কাছে স্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের দাবি রাতে দিনে গাড়ি করে রোহিঙ্গার স্রোত আসছেই, এটা কোনভাবে থামানো যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের স্বাভাবিক পরিবেশে মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ায় ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ছে বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় পৌর কাউন্সিলার আকতার কামাল। তিনি জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে এখানে প্রচুর রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। শহরের টেকপাড়া, লারপাড়া, আলীর জাহাল ওবাহারছড়ায় অসংখ্য রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া শহরের রুমালিয়ারছড়া, পেতা সওদাগর পাড়া, এসএম পাড়া, নুনিয়ারছড়া পেশকার পাড়া, লাইট হাউজ সমিতি পাড়াসহ সব এলাকায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে স্থানীয়দের সূত্রে দাবি করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দেবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড ॥ রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তাদের সমুদ্র উপকূলে পৌঁছতে পারলেই সেসব দেশ রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দেবে। মালয়েশিয়ার মেরিটাইম সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, তাদের কোস্ট গার্ড রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেবে না এবং সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে। মালয়েশিয়ার মেরিটাইম সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু হওয়ার পর মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। এখনও অনেকে সীমান্তে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরেও অনেক রোহিঙ্গা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তাদের মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও সাহায্যকারী সংস্থাগুলো। মালয়েশিয়া মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির মহাপরিচালক জুলকিফলি আবু বকর জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আরও অনেক রোহিঙ্গা নৌকা নিয়ে আসতে পারে। তাদের জন্য আমাদের দরজা খোলা। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা তাদেরকে প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া কথা ছিল। কিন্তু দিন শেষে আমরা সবাই মানুষ। আর মানবিক কারণেই আমার এই কাজ করতে পারব না।’ অপরদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক। ওই মিশনের নেতৃত্ব দেবে মালয়েশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী। এক বিবৃতিতে নাজিব রাজ্জাক বলেন, ওই মিশনের মাধ্যম রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করবে মালয়েশিয়া। নাজিব বলেন, সীমান্তে একটি সামরিক হাসপাতাল স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলবে মালয়েশিয়া। এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনে ৫৯ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তে রোহিঙ্গাদের গণকবর পাওয়া গিয়েছিল। মালয়েশিয়ায় ইতোমধ্যে এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। নতুনদের হয়ত অভিবাসী আটক কেন্দ্রে রাখা হবে বলে জানান তিনি। জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর না করা মালয়েশিয়া সব অভিবাসীকে অবৈধ বলে মনে করে। তবে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেবে বলে এবার ঘোষণা দিয়েছে তারা। থাইল্যান্ড সরকারও জানিয়েছে, তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ॥ এদিকে ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশে কেউ যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গীরা যাতে চাঙ্গা হতে না পারে, এজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি ও তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে শনিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু উগ্রমনা লোক অপৎপরতা চালাচ্ছে কি-না বা অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে কি-না আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ ইস্যুতে কাজ করছে। মনিরুল বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি সরকার মানবিক আচরণ করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে তাদের জঙ্গীবাদে রিক্রুট করতে না পারে এবং ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গীবাদকে সক্রিয় করতে না পারে, সে তৎপরতা অব্যাহত আছে। খাদ্যের জন্য আহাজারি ॥ উখিয়া থেকে টেকনাফ সড়কের কুতুপালং আমতলী থেকে বালুখালী পর্যন্ত সড়কে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্রোত থেমে নেই। এর আশপাশে পাহাড়ী এলাকা ও সমতল জমিতে হাজারো রোহিঙ্গার অবস্থান হয়েছে। সড়ক দিয়ে যানবাহন যেতে দেখলেই রোহিঙ্গারা ভিড় জমাচ্ছে। হাত পেতে তারা খাদ্য ও অর্থের জন্য আহাজারি করছে। শনিবার পর্যন্ত এমন চিত্র প্রতিটি পয়েন্টে ছিল লক্ষণীয়। সর্বস্ব হারিয়ে রোহিঙ্গারা এখন কপর্দকহীন। একদিকে দেশছাড়া, অপরদিকে সহায়-সম্পদ হারিয়ে এখন তারা রীতিমতো ভিক্ষার পথ বেছে নিয়েছে। সৌদিভিত্তিক মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের বক্তব্য ॥ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম নাগরিকদের ওপর নৃশংস হামলা ও গণহত্যা মানবতার জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা এবং এটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা এবং জাতিগত আদর্শকে হত্যা করার প্রকাশ্য উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছে সৌদি এনজিও সংস্থা ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ (এমডব্লিউএল)’। এক বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারে যে রক্তপাত চলছে তা আইএস এবং আল কায়েদার সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে কোন অংশে কম নয়। এটি চরমপন্থা ও নৃশংসতার সর্বোচ্চ পর্যায় অতিক্রম করেছে। এতে আরও বলা হয়, যদি এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে বিশ্ব ব্যর্থ হয় তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়বে। আরসার ঘোষণা ॥ রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে বলে আবারও ঘোষণা দিয়েছে। আরসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের বর্তমান সশস্ত্র বিদ্রোহ জিহাদ নয় বরং তারা জাতিগত মুক্তিকামী। মিয়ানমারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। হংকংভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা এশিয়া টাইমসে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আরসা নেতা মোঃ আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির মুখমাত্র মোঃ আবদুল্লাহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, মুসলমান বলেই আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে আন্তর্জাতিক জিহাদী তৎপরতার সম্পর্ক আছে বা তারা আমাদের খেয়ে ফেলতে পারবে, এমন দাবি ঠিক নয়। ২৫ আগস্টের হামলার একদিন পর তার এ সাক্ষাতকার নেয়া হয় এবং তা বারবার অনলাইন মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে। আরসার প্রধান নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নিয়োজিত মুখপাত্র বলে দাবি করে ওই সাক্ষাতকারে আবদুল্লাহ আরও বলেছেন, আরসার লড়াই জাতীয়তাবাদী। তারা জিহাদী নয়। আরসার কর্মপদ্ধতি, কাজের ধরন, যেভাবে তারা সংগঠন চালায় এবং যে লক্ষ্যের দিকে তারা চলছে, তাতেও এটা স্পষ্ট। এর কোনটাই পাকিস্তানী কিংবা অন্য কোন জিহাদী গোষ্ঠীর লক্ষ্যের সঙ্গে মেলে না। তারা আসলে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোরই মতো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তার আহ্বান, আরসাকে সন্ত্রাসবাদী ভাবা কিংবা মিয়ানমার সরকারের ‘ফাঁদে পড়া’ থেকে সতর্ক থাকুন। আরসা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানই চায় বলে সংগঠনটির মুখপাত্র আবদুল্লাহ সর্বশেষ জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়েই সম্ভব। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যে অনাচারের শিকার হয়েছে, তার নীলনকশা অনেক গভীরে। তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কর্মকা-ের বিচার চায়। তিনি এও বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের প্রতি রাজনৈতিক চাপ বাড়াবে। এদিকে, সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বহু রোহিঙ্গা পুরুষ ও যুবক তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সীমান্তের ওপারে আত্মগোপনে রয়েছে। স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তাদের অনেকে ফিরে গেছে নিজ নিজ অবস্থানে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান তারা সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারও তাদের সেনা নেতৃত্বাধীন অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এপারে চলে আসা বহু রোহিঙ্গা নারী বলেছেন, তাদের স্বামীরা এই বলে তাদের আশ্বস্ত করেছেন, অধিকার আদায় হলে দেখা হবে। আর যদি মৃত্যু হয় তা হবে তাদের নিজস্ব ভূমি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। আরসাকে বেআইনী ঘোষণা ॥ মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে আরসাকে ‘বাঙালী সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিযোগ করে আসছে। ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটিকে বেআইনী ঘোষণা করে মিয়ানমার। আউং সান সুচি আরসাকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে অভিহিত করে মিয়ানমারের গণমাধ্যমকে তাদের পক্ষে কথা বলার বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছেন। নিপীড়িতদের কিছু কাহিনী ॥ সীমান্ত অতিক্রম করে রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গা নারী সানজিদা খাতুন এখন প্রায় পাথর, কারণ সেনাবাহিনীর গুলি ও মাইনের আঘাতে চোখের সামনে প্রাণ গেছে তার কিশোর পুত্রের। কবর দেয়ার সময় কাফনের কাপড়ও দিতে পারেননি। দশ সন্তানের আরেকজনের কোন খোঁজ নেই কয়েকদিন ধরে। তিন দিন আগে সীমান্ত অতিক্রম করা রাখাইন প্রদেশের বুচিদংয়ের টংবাজারের সানজিদা খাতুন ও তার স্বামী জাকারিয়ার সঙ্গে শনিবার সকালে কথা হয় টেকনাফের কানজরপাড়ায়। সেখানকার একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন পুরো পরিবার নিয়ে এই দম্পতি। মোহাম্মদ জাকারিয়া নামে অনুপ্রবেশকারী আরেক রোহিঙ্গা জানান, গত ২৫ আগস্ট শুক্রবার দুপুরের দিকে তাদের গ্রামে হামলা হয়। গুলি ও বিস্ফোরণে ছেলে সাইফুলের হাঁটু থেকে নিচের অংশ উড়ে যায়। গুলির মধ্যে ছেলেকে কাঁধে করে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পরও বাঁচানো যায়নি। রক্তে ভেসে গেছে তার সন্তানের শরীর। মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল সে। গিয়েছিলও। কিন্তু মায়ের কোলেই তার মৃত্যু হয়। তখন পাড়ার সব লোক অন্যদিকে সরে যাচ্ছিল। তিন-চারজন মিলে দাফন করেছি, ছেলের গায়ে রক্তমাখা যে কাপড় ছিল, তাই দিয়ে কবরে শুইয়ে দিয়েছি। মা সানজিদা খাতুন বলেন, ছেলেকে যখন আমার কাছে এনেছে তখন পুরো শরীরে রক্ত, একটু পানি খেতে চেয়েছে, বুকে জড়িয়ে ধরতে বলেছে, বলেছে আমাকে মাফ করে দিও। ছেলেকে দাফন করার সময় কাফনের কাপড় দূরে থাক, এক টুকরা কাপড়ও দিতে পারিনি। পরনে যা ছিল তা দিয়েই কবরে রেখে আসতে হয়েছে। ১৫ বছরের ছেলে সাইফুল ছাড়াও জাকারিয়া-সানজিদা দম্পতির আরও কয়েক নিকটাত্মীয় সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে। ছেলে মারা যাওয়ার বীভৎস ঘটনায়ও এখন আর তেমন প্রতিক্রিয়া নেই তাদের। কারণ যে সন্তানরা জীবিত আছে তাদের মধ্যে একজন নিখোঁজ। অপর আটজনকে নিয়ে এখন কোথায় যাবেন। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লক্ষাধিক। শনিবার পর্যন্ত গত ১৫ দিন ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রতিনিয়ত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। নানা প্রতিকূলতা ও দুর্ভোগ সহ্য করে মাইলের পর মাইল হেঁটে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের সীমান্ত অতিক্রমের কাহিনী রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। ৩০ বছরের বিধবা রহিমা তিন কিশোর সন্তান নিয়ে মংডুর দারোগাপাড়ার স্বামীর ভিটে ছেড়ে এসেছেন তিন দিন আগে। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল কেড়ে নেয়ার যন্ত্রণায় বিলাপ এখন তার একমাত্র অবলম্বন। কানজরপাড়ার বিলের আইলে বসে থাকা অবস্থায় মিয়ানমারের পরিস্থিতি কেমন এটা জানতে চাওয়া হলে রহিমা শুধুই বিলাপ করেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তজুড়েই এমন পরিস্থিতি। এখানে কেউ কাউকে সান্ত¡না দেয়ার পর্যায়েও নেই। ষাটোর্ধ হাসিনা খাতুন নামের এক রোহিঙ্গা নারী নিজের দেশে ইতোপূর্বে কয়েক দফায় সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু কখনও দেশ ছাড়ার চিন্তা করেননি। এবার ঠিকই ছেলে ও নাতির কাঁধে চড়ে অনুপ্রবেশকারী জীবন বেছে নিতে হয়েছে। ষাটের দশক থেকে তৎকালীন আরাকান রাজ্যে (বর্তমানে রাখাইন) রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬ এবং সর্বশেষ চলতি ২০১৭ সালে ছয় দফায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়নে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটল। তাও আবার শত নয়, হাজার নয়; লাখে লাখে। মাকে কাঁধে নিয়ে পুত্রের ২৯ মাইল হাঁটা ॥ ৯৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মাকে কাঁধে নিয়ে ২৯ মাইল হেঁটে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন পুত্র সাইফুল্লাহ (৩৫)। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেয়া হয়েছে। শুধু প্রাণ নিয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে নিয়ে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। চার দিন ধরে মা ফরিদা খাতুনকে সাইফুল্লাহ কাঁধে নিয়ে ২৯ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্তে পৌঁছানোর পর অনুপ্রবেশ করেছেন বলে দাবি করেন। কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ের দক্ষিণে বালুখালী এলাকায় সাইফুল্লাহ যখন সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তার কাঁধে ছিল বৃদ্ধা মা ফরিদা খাতুন। পাশে নির্বাক ছিলেন বৃদ্ধ বাবা আবুল খায়ের। সাইফুল্লাহ জানিয়েছেন, মংডুর রাচিদং এলাকার ধইচ্যাপাড়ায় তাদের বসতবাড়ি। পরিবারের ১৮ সদস্য নিয়ে ৮০ হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া দিয়ে তারা নাফ নদী অতিক্রমের পর উখিয়ার মনখালীতে পৌঁছান। সেখান থেকে বর্তমানে বালুখালী ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছেন। ডেনমার্কের পক্ষে ২৫ কোটি টাকা অর্থ সহায়তা ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ডেনমার্ক সরকার ২৫৬ মিলিয়ন বা ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর (ডব্লিউএফপি) মাধ্যমে এ অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। শনিবার ডেনিশ উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে। এর আগে জাতিসংঘসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের পক্ষেও অনুরূপ আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
×