ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘সকলে জানুক আদুরিরাও মানুষ’- ফেসবুকে হাজারো প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ জুলাই ২০১৭

‘সকলে জানুক আদুরিরাও মানুষ’- ফেসবুকে হাজারো প্রতিক্রিয়া

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ শিশু গৃহকর্মী আদুুরির ওপর বর্বর নির্যাতনের মামলায় গৃহকর্ত্রী নওরিন জাহান নদীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ১ লাখ টাকা জরিমানা দেয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন দেশবাসী। মঙ্গলবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার এ রায় ঘোষণা করেন। এই রায়কে দেশবাসী দৃষ্টান্তমূলক সাজা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় রায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বিচার বিভাগের প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করেছেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যেন কোন গৃহকর্ত্রী গৃহকর্মীর উপর নির্যাতন করার দুঃসাহস না পান সে বিষয়েও সতর্ক করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্লবীর একটি ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় আদুরিকে (১১) উদ্ধার করা হয়েছিল। চার বছরের ব্যবধানে আদুরির শারীরিক কাঠামো পরিবর্তন হলেও নির্যাতনের ক্ষতচিহ্নগুলো এখনও রয়ে গেছে। এখনও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা নিয়ে ভুগছে আদুরি। নির্যাতনের সময় গৃহকর্ত্রী নদীকে আগুনের ছ্যাঁকা দেয়ায় তার জিহ্বা ক্ষতিগ্রস্ত, তাই স্বাভাবিক মানুষের মতো কথাও বলতে পারে না আদুরি। রায়ের পর অস্পষ্ট ভাষায় সে বলেছে, নির্যাতনের বিচার পেয়েছি, আমি খুশি। সন্তোষ জানিয়ে বড় ভাই সোহেল মৃধা বলেন, আমার বোনরে যে নিয়া এই দোজগের আগুনে ফালাইছেন, সেই চুন্নু মিয়া আগে থাইকা ছাড়া পাইয়া যাওয়ায় কষ্ট হইছিল। তয় মূল অপরাধীর সাজায় খুশি। মা সাফিয়া বেগম বলেন, যতই অভাব-অনটন থাউক, আইজ মাইয়াডার দশা এইরহম অইবে হ্যাঁ বোঝলে কামে দেতাম না। তারে যে এই দশা করছে, তার শাস্তি পাইছি, ভালো লাগতাছে। আদুরির পরিবারকে এ মামলায় আইনী সহায়তা দেয়া মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। যদি আদুরির পরিবার চায়, তাহলে তার সারা জীবনের কর্মসংস্থান আমরা করে দেব।’ এই রায়ে আদুরির পরিবার ও রাষ্ট্রপক্ষ যেমন খুশি তেমনি দেশবাসীও খুশি। ফেসবুকে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে দেয় গৃহকর্ত্রী নদীর যাবজ্জীবন রায়ে খুশি তারা। মঙ্গলবার রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা সংবাদটি শেয়ার করে অনেকেই বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে মফিদুল আলম তপু নামের একজন লিখেছেন, ‘যাবজ্জীবন শাস্তি হয়ত উচ্চ আদালত কমিয়ে দেবেন। কিন্তু অন্তত ৮ থেকে ১০ বছর সশ্রম কারাদ- হওয়া উচিত নিদেনপক্ষে। এ্যাটেম্পট টু মার্ডার মামলা, সুপ্রমীকোর্টের আইনজীবী চাইলে এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ও বহাল রাখা সম্ভব হতে পারে। আদুরি দরিদ্র পরিবারের বলে যেন তার নির্যাতনকারী রেহাই না পায়।’ শান্তা আনোয়ার লিখেছেন, ‘১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতন করে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার দায়ে গৃহকর্ত্রী নওরিন জাহান নদীর যাবজ্জীবন কারাদ-। কারাদ-প্রাপ্ত নদী হুমকি দিয়েছে ‘সে’ পাঁচ তলা থেকে লাফ দিবে, এমন নদী দশটা-বিশটা যদি মরে যায়; জাতির কি কোন ক্ষতি হবে? মারজানা ফেরদৌস রুবা লিখেছেন, ‘আমি চাই আদুরি প্রতি তিনমাস পরপর যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত নদীকে দেখতে এসে প্রতিবার জিজ্ঞেস করে যাক, ‘কেমন আছেন ম্যাডাম?’ আদুরিদের যারা নির্দ্বিধায় ডাস্টবিনের কিট বানিয়ে ফেলতে পারে, তারা জানুক আদুরিরাও মানুষ। আর মানুষ মানুষের জন্যই, মানুষের পৃথিবীতে অমানুষদের স্থান নেই।’ সাজ্জাদ হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘ন্যায় বিচার পেল আদুরি। একজন সাবলিল মেয়েকে নির্যাতন করে কংঙ্কাল বানিয়ে গৃহকর্মী ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যায়। মানুষ কত নিষ্ঠুর হলে এ জঘন্য কাজটা করতে পারে।’ ‘গৃহকর্মী আদুরি নির্যাতন মামলার রায় হয়েছে। গৃহকর্ত্রী নওরিন জাহানের যাবজ্জীবন কারাদ- এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই রায় থেকে আশা করি ভদ্রবেশী বিকৃত মানসিকতার মহিলারা কিছুটা হলেও শিক্ষা নেবেন বলে ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন খালেদা রেজা। আবু নাঈম সিফাতের মতে, ‘অবশেষে ৪ বছর পর সঠিক বিচার পেল আদুরি।’ এরপর তিনি উপহাস করে লিখেছেন, নদী খালার পরিবারে মনে হয় কোন রাজনীতিবিদ নেই। তাহলে অনেকের মতো এটারও বিচার হয়ত হতো না।’ ফাতেমা আবেদিন নাজলা আদুরির প্রতি শুভকামনা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আদুরি ভালো থাকুক, যাবজ্জীবনের চিন্তায় এবার যদি গৃহকর্ত্রীরা নির্যাতন বন্ধ করেন।’ সোহেল আহমেদ , ‘নদী যদি মমতাময়ী না হয়, নদী যদি আদুরি না হয়- তবে নদীর যাবজ্জীবন কারাদ- তো বেশি কিছু নয়।’ আদুরি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠির কৌরাখালি গ্রামের প্রয়াত খালেক মৃধার সপ্তম কন্যা। অভাবের সংসারে মা সাফিয়া বেগম দিশেহারা হয়ে নয় সন্তানকেই গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজে দেন। আদুরিকে এক প্রতিবেশীর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবীতে নওরিন জাহান নদীর বাসায় কাজে দেয়া হয়েছিল। সেখানে নানা অজুহাতে দিনের পর দিন অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকে আদুরি। নির্যাতনের একপর্যায়ে নদী ও তার মা মৃত ভেবে আদুরিকে ডাস্টবিনে ফেলে দেন। সেখান থেকে দুই নারী কর্মী অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন আদুরিকে। পরে পুলিশের সহায়তায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে ভর্তি করা হয়। দেড় মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হলে পরিবারের কাছে আদুরিকে হস্তান্তর করা হয়। উদ্ধারের তিনদিন পর পল্লবী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন আদুরির মামা নজরুল চৌধুরী। এজাহারে গৃহকর্ত্রী নদী, তার মা ইসরাত জাহান, স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ এবং তাদের আত্মীয় সৈয়দ চুন্নু মীর ও মোঃ রনিকে আসামি করা হয়। মামলায় গ্রেফতার হলে ওই বছর ১ অক্টোবর দোষ স্বীকার করেন গৃহকর্ত্রী নদী।
×