ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

টিআর কাবিটা প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৭ জুলাই ২০১৭

টিআর কাবিটা প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ) এবং কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) কর্মসূচীতে লুটপাটের ঘটনার ঘটেছে। কোন প্রকার কাজ না করে সম্পূর্ণ ভুয়া বিল ভাউচারে সরকারী অর্থ ভাগবাটোয়ার করে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুটি উপজেলা রৌমারী ও রাজীবপুরে পিআইও’র (প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) পদ শূন্য। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন রাজীবপুরে উলিপুরের পিআইও ফিজানুর রহমান এবং রৌমারীর চিলমারীর পিআইও সিরাদ্দৌলা। তারা দু’জন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করলেও কোনদিনও রাজীবপুর ও রৌমারীতে আসেননি। প্রকল্পের কাজ হয়েছে কিনা তা তদারকিও করা হয়নি। ঘুষের পার্সেন্ট পাওয়ার পর চোখ বন্ধ করে বিল ছাড়া হয়েছে। কাগজে কলমে বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের কাজ হয়েছে এমন কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় (পিআইও) সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে টিআর (সাধারণ) কর্মসূচীর আওতায় ১০১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যা ব্যয় হয়েছে ৪৯ লাখ ১০ হাজার ৩২৩ টাকা। টিআর (বিশেষ) কর্মসূচীর আওতায় আরও ৪০টি প্রকল্পের বিপরীতে ২৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অপরদিকে কাবিটা (সাধারণ) কর্মসূচীর আওতায় ৩২টি প্রকল্পে ৪৯ লাখ ১৯ হাজার এবং কাবিটা (বিশেষ) কর্মসূচীর আওতায় আরও ১২টি প্রকল্পে প্রায় ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। সিংহভাগ প্রকল্পে রাস্তার মাটি কাটার কাজ রয়েছে যা শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং সমুদয় বিলও উত্তোলন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিআইও অফিসের কাগজে কলমের চিত্র আর বাস্তবের সঙ্গে কোন মিল নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকল্প সভাপতি অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকার ১০ পার্সেন্ট টাকা অফিসের কর্মী কেটে নিয়ে বাকি টাকা বিল দিয়েছে। পিআইও অফিস বলে দিয়েছে কাজ করলেও ১০ পার্সেন্ট হারে টাকা দিতে হবে। এ কারণে কেউ কাজ করেনি। সরেজমিনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। কাবিটা কর্মসূচীর আওতায় ‘চরনেওয়াজী হাইস্কুল থেকে পূর্বদিকে ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ নামের প্রকল্পে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্প সভাপতি করা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি সদস্য আলম মিয়াকে। একই রাস্তায় ‘চরনেওয়াজী হাইস্কুল থেকে পশ্চিম দিকে রাস্তা মেরামত’ পৃথক আরেকটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের সভাপতি হলেন সংসদ সদস্য নাসিমা বেগম। দুটি প্রকল্পের একটিতেও এক কোদাল মাটিও ফেলা হয়নি। অভিযোগ প্রসঙ্গে দুই প্রকল্প সভাপতি বলেন, ‘প্রকল্প সভাপতি আমাকে করা হলেও সব টাকাই নিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন।’ অপরদিকে কাবিটা কর্মসূচীর আওতায় ‘চররাজীবপুর মাঠপাড়া বাজার হতে উত্তর দিকে ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ প্রকল্পে প্রায় এক লাখ এবং ‘মরিচাকান্দি আবু সাইদের বাড়ি হতে পশ্চিম দিকে বাদল চেয়ারম্যানের বাড়ি হয়ে কোমড়ভাঙ্গি বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ প্রকল্পে ৩ লাখ টাকা কাজ না করেই তুলে নেয়া হয়েছে। ওই দুই প্রকল্পের সভাপতি যথাক্রমে ইউপি সদস্য সুরমান আলী ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল আলম বাদল। সরকারী নিয়ম অনুসারে চেয়ারম্যানরা প্রকল্প সভাপতি হতে পারবে না। কিন্তু এখানে তা মানা হয়নি। তারা বলেন, ‘আমরা তাও কিছুটা কাজ করেছি। অন্য ইউনিয়নে যে এক কোদাল মাটিও ফেলা হয়নি। সেগুলো খোঁজ নেন।’ একই ভাবে টিআর কর্মসূচীর আওতায় ‘দক্ষিণ কোলপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাটি ভরাট’ প্রকল্পে এক লাখ টাকা এবং কাচারিপাড়া খবির মেম্বারের বাড়ি হতে সবুর ফারুকীর বাড়ি হয়ে আকবরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ’ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত দুই লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। জানা গেছে, ৩০ জুনের মধ্যেই টিআর আর কাবিটার সব প্রকল্পের বিল তুলে নেয়া হয়েছে। বিল প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকল্প সভাপতির নামে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে বিল দেয়া হলেও হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে প্রকল্পের সভাপতির নামে নির্দেশনা না দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয় পিআইও অফিসের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী সাইদুর রহমানের নামে। এর ফলে প্রকল্প সভাপতিরা পিআইও অফিসের ওই কর্মচারীকে ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে ওই কর্মচারী ব্যাংকে বসে থেকে প্রকল্প সভাপতিদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষের টেন পার্সেন্ট টাকা কেটে রাখে। এ নিয়ে প্রকল্প সভাপতিরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশও করেন। উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান মল্লিক ঘুষ গ্রহণের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘একদিনে প্রায় দুইশ’ প্রকল্পের বিল জমা দেয়া হয়। যা প্রত্যেক প্রকল্প সভাপতির নামে আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব না হওয়ার কারণে পিআই অফিসের ওই কর্মচারীর নামে ব্যাংক নির্দেশনা পাঠানো হয়। টেন পার্সেন্ট টাকা কেটে রাখার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ অভিযুক্ত কর্মচারী সাইদুর রহমান বলেন, ‘পিআইও স্যারের নির্দেশেই আমার নামে ব্যাংক এডভাইস দেয়া হয়েছে। এখানে আমার করার কিছুই নেই। রৌমারী উপজেলা টিআর কর্মসূচীর (সাধারণ) ১২২টি প্রকল্পে এক কোটি ৩৮ হাজার এবং টিআর বিশেষ ১৪০ প্রকল্পে বরাদ্দ এক কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কাবিটা কর্মসূচীর (সাধারণ) ৩১ প্রকল্পে এক কোটি ৭ লাখ এবং কাবিটা বিশেষ ৩৩ প্রকল্পে প্রায় ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, ঈদের আগে ২১ জুন সারা রাত পিআইও অফিস খোলা ছিল। কেউ যাতে না জানতে পারে সে জন্য ওই রাতে টেন পার্সেন্ট ঘুষের টাকা নিয়ে প্রকল্প সভাপতিদের বিল দেয়া হয়েছে। সরেজমিনে রৌমারী উপজেলার কাবিটা কর্মসূচীর আওতায় ‘যাদুরচর নতুন গ্রাম মোড় হতে আব্দুস ছাত্তারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ’ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত দুই লাখ টাকা তুলে নেয়া হলেও কাজ করা হয়নি কোথাও। এ বিষয়ে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা রাজীবপুরের পিআইও ফিজানুর রহমান এবং রৌমারীর পিআইও সিরাদ্দৌলা বলেন, ‘আমাদের এখানে কাজ করে সময় পাই না ওখানে যাব কিভাবে। বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো ঘুরে আমাদের দেখা হয়নি এটা সত্য। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও এমপি বিল দিতে বলেছে তাই আমরা দিয়েছি। টেন পার্সেন্ট ঘুষ নেয়ার বিষয়টি সত্য নয়।’ রৌমারী রাজিবপুর উপজলার দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাউজুল কবীর বলেন, ‘টিআর কাবিটা প্রকল্পে কাজ হয়নি-এমন অভিযোগ কেউ করেনি।
×