ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী নাশকতার আশঙ্কায় কারাগারে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২০ এপ্রিল ২০১৭

জঙ্গী নাশকতার আশঙ্কায় কারাগারে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা

শংকর কুমার দে ॥ দেশের সাতটি জঙ্গী সংগঠনের কারাবন্দীদের নাশকতার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে কারাগারগুলো। দেশের ৬৮ কারাগারে আটক আছে এমন জঙ্গীর সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। এর মধ্যে তিন শতাধিক দুর্ধর্ষ জঙ্গী আছে, যারা ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি। এসব দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার সময় ও এমনকি কারাগার থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে জঙ্গীরা। সাধারণ বন্দীদের সঙ্গে মিলে আটক জঙ্গী আসামিরা ও ফাঁসির দ-প্রাপ্তরা কারাগারের ভেতরে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সম্প্রতি এই ধরনের আশঙ্কার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে, কারাগারগুলোতে যে সাতটি জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীদের বিরুদ্ধে মামলা, সাজা, পলাতক থাকার অভিযোগ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে, হিযবুত তাহরীর, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), বাংলাদেশের জাগ্রত মুসলিম জনতা (জেএমজেবি), শাহাদাত আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও আনসারুল্লাহ বাংলাটিম (এবিটি) ও নব্য জেএমবি। এর মধ্যে কেবলমাত্র নব্য জেএমবি ছাড়া বাকি ছয়টি জঙ্গী সংগঠনই নিষিদ্ধ। সারাদেশের বিভিন্ন থানায় এসব জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে সহস্রাধিক। সহস্রাধিক সংখ্যক মামলার আসামি জঙ্গীদের মধ্যে তিন শতাধিক জঙ্গী ফাঁসির দ- মাথায় নিয়ে কারাগারের বন্দী। এর মধ্যে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে মাত্র দশজনের। সর্বশেষ ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে হুজিপ্রধান মুফতি হান্নানের। চলতি এপ্রিলে তার ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে গত মার্চে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে জঙ্গীরা। হুজিপ্রধানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে হাজির করা হয়নি নাশকতার আশঙ্কায়। হুজিপ্রধানসহ তিন জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকরের সময়েও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ধারাবাহিক অভিযানে দেশে জঙ্গী কর্মকা- কমে এলেও কারাবন্দী জঙ্গীদের নাশকতার আশঙ্কা রয়ে গেছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। কারা সূত্রে জানা গেছে, কারাবন্দী জঙ্গীরা যাতে বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারে সে জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে বন্দী জঙ্গীদের ওপর নজরদারির জন্য ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) বসানো হচ্ছে। কারা কর্তৃপক্ষও জঙ্গীদের বিষয়ে বিশেষ সতর্ক রয়েছে। তারা যাতে সাধারণ বন্দীদের যাতে প্রভাবিত করতে না পারে সে জন্য জঙ্গীদের আলাদা সেলে রাখা হচ্ছে। নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে করাবন্দী জঙ্গীদের। কারাগার সূত্রে জানায়, হুজিপ্রধান মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গী ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে দুই বিচারক হত্যা মামলার রায়ে গত বছরের অক্টোবরে সর্বশেষ দুই বিচারক হত্যা মামলায় খুলনা কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি নেতা আসামি আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের। এর আগে দুই বিচারক হত্যা মামলার ফাঁসির রায়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুকের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। ২০০৫ সালের ১৪ নবেম্বর সকালে ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতে যাওয়ার পথে দুই বিচারককে বহনকারী মাইক্রোবাসে বোমা হামলা করে জ্যেষ্ঠ বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদকে হত্যা করে জঙ্গীরা। কারাগার সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসির দ- মাথায় নিয়ে আটক জঙ্গীদের অনেকেরই নিম্ন আদালতে ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আবার উচ্চ আদালতে কারও কারও আপীল মামলা চলছে। আবার কোন কোন আসামির মামলা নি¤œ আদালতে শেষ হয়েছে। সেখানে মৃত্যুদ- দিয়ে রায় হয়েছে। তবে এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় হলে তারা রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব মিলিয়ে এখনও সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলার রায় না হওয়ায় তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আইনী প্রক্রিয়া শেষে তাদের বিরুদ্ধে নি¤œ আদালতের দেয়া রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকলে সকলকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে। ফাঁসির আসামিদের যেখানে রাখা হয় সেই কনডেম সেল, যাকে এককথায় বলা হয় কারাগারের ভেতর আরেক কারাগার। তারপরও ফাঁসির আসামি ও কারাবন্দী জঙ্গীদের বিষয়ে কারাগারগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে জেএমবি কর্তৃক সিরিজ বোমা হামলার পর ওই জঙ্গী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাড়ে ৩০০ মামলা হয়। এর মধ্যে দুই শতাধিক মামলার রায় দিয়েছে আদালত। এসব রায়ে সারাদেশে ৫৪ জন জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তার মধ্যে মাত্র ৭ জঙ্গীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়াও ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে হত্যাচেষ্টা মামলায় হুজিপ্রধানসহ তিনজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলেও আরও প্রায় তিন শতাধিক জঙ্গী ফাঁসির আসামি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কারাগারগুলোতে ফাঁসির আসামির সংখ্যা বেড়ে চলেছে। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিসহ কারাবন্দী জঙ্গীরা সাধারণ বন্দীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করছে। বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক আটক জঙ্গীও মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত জঙ্গীরা সাধারণ বন্দীদের সঙ্গে মিলে কারা অভ্যন্তরে যে কোন সময় বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ জঙ্গীরা কারাগারের ভেতরে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে থাকে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত তাদের আত্মীয়স্বজনও কারাগারে দেখা করতে আসেন। এমন পরিস্থিতিতে কারাগারে আটক জঙ্গী ও ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে বিপাকে রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে চলমান জঙ্গীবিরোধী অভিযানের ফলে আটক জঙ্গীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি ফাঁসির দ-প্রাপ্তদেরও ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় জঙ্গীরা নাশকতার পথ বেছে নিতে পারে কারাগারগুলোকেই। এমনিতেই বিপুলসংখ্যক বন্দী নিয়ে বিপাকে কারা কর্তৃপক্ষ। তারওপরে আটক জঙ্গীদের নাশকতার আশঙ্কার বিষয়টি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে এ ধরনের আশঙ্কার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার পর থেকে কারাগার কর্তৃপক্ষ বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে।
×