ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্প-সাহিত্যের আলিঙ্গনে ঝলমলে সিলেট

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শিল্প-সাহিত্যের আলিঙ্গনে ঝলমলে সিলেট

মনোয়ার হোসেন ॥ ষাটের দশকের গল্পের স্মৃতিকারতা নিয়ে শুরু হলো সকাল। দুপুর পর্যন্ত হলো কবিতার কথা। মাঝে বিরতি দিয়ে হয়ে গেল সাহিত্যের নির্যাসে গড়া মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রের আলাপ। দুপুর গড়িয়ে যাওয়া বিকেলে হলো লোকসাহিত্য এবং ভিন দেশে প্রবাসী জীবনের আলোচনায় সাজানো দু’টি অধিবেশন। দিনভর ছয়টি অধিবেশনে অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সমালোচকসহ নানা ভুবনের মানুষ। ডুবে যাওয়া বিকেল শেষে সন্ধ্যার সূচনা হলো গম্ভীরা গানের সুরে। এরপর রাত অবধি পরিবেশিত হলো মঞ্চনাটক থেকে সেকালের বাংলা গান এবং নজরুলসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের মোহময় পরিবেশনা। এভাবেই শিল্পের সঙ্গে সাহিত্যের আলিঙ্গনে ঝলমলে রূপ নিয়েছে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব। আর এমন মনন আলোড়িত ও মনমাতানো আয়োজনে সিলেট শহরে বইছে যেন বসন্ত বাতাসমাখা প্রাণের হিল্লোল। নিসর্গের সৌন্দর্য¯œাত এবং জ্ঞানী-গুণীদের শহরটি যেন সুন্দর ও শুভ চেতনার কথা। সিলেট উপশহর পয়েন্টের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে চলছে মানবিক সাধনার আহ্বানে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব। দশ দিনের এ উৎসবের চতুর্থ দিন ছিল শনিবার। এদিন সকালে কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলনের সূচনা হয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদিত ষাটের দশকের প্রতিবাদী চেতনায় সৃষ্ট গল্প ও গল্পকারদের কথা দিয়ে। সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হয় সৈয়দ শামসুল হক স্মারক অধিবেশন। আলোচনার বিষয় ছিল ‘ষাটের দশক : তখনকার গল্প এখনকার স্মৃতি’। এ বিষয়ে মূল বক্তব্য রাখেন গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। আলোচনায় অংশ নেন কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা এবং ছোটগল্পের লেখক কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া। সভাপতিত্ব করেন এই সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ষাটের দশকের গল্পের চরিত্র মেলে ধরে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বলেন, সেই সময়ের গল্পে নতুনত্বের যুক্ত হয়েছিল নিরীক্ষাধর্মী প্রবণতা। পরাধীন দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যা ঘটছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে গল্প কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমেÑলেখকদের ভেতরে একটা স্পৃহা কাজ করেছে সেই সময়। প্রচলিতে প্রেম কিংবা বিরহমাখা গল্প লেখার বাইরে লিখতে হবে নতুন ধারায়। সমাজের সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে আবির্ভূত হয়ে গল্পকারদের গল্প। এই আলোচকের আলোচনার সূত্র ধরে উঠে ষাটের দশকে প্রতীকী আশ্রয়ে প্রতিবাদী গল্প লেখক শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ সেই একঝাঁক তরুণ প্রাণ লেখকের কথা। সুব্রত বড়ুয়া বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও একষট্টি সালের রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিক উদ্্যাপনে পাকিস্তানিদের বাধাদান ও ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা রেখাপাত করেছে সেই সময়ের লেখকদের। ভয় নামের গল্প লিখে প্রতীকীভাবে বিরুদ্ধ সময়ের চিত্র এঁকেছিলাম। পাকিস্তানের অধীনে থাকা উত্তল ওই সময়টাই আমাদের সত্তা ও চিন্তায় এনেছিল পরিবর্তন। প্রশান্ত মৃধা বলেন, ষাটের দশকে রাজনীতিতে একটা নির্মম পরিহাস চলছিল। সেই পরিহাসেরই প্রতিবাদ হিসেবে গল্পের মাধ্যমে বয়ান দিয়েছিলেন তখনকার লেখকরা। সেই সময়ের গল্পগুলোই পরবর্তীতে প্রভাব বিস্তারী ভূমিকা রাখে সত্তরের দশকেও। আবুল মোমেন বলেন, ওই সময়টা ছিল রাজনীতি ও সংস্কৃতির অগ্নিগর্ভ সময়। সেটা ছিল সাহিত্যের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সময়। পাকিস্তানের কবল থেকে বেরিয়ে আসা স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তৎকালীন লেখকদের। সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে ষাটের দশককে সারা পৃথিবীর জন্য সুন্দর সময় বলে উল্লেখ করেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বলেন, লেখালেখি কিংবা এই ভূখ-ের সংগ্রামী রাজনীতির ইতিহাসে ওই সময়টা ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর। সবকিছুতেই ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার আভাস। ষষ্ঠ অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘কবিতার ভুবনে বিরোধাবাস’। সাহিত্য সমালোচক কায়সার হকের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন ভারতের বিশিষ্ট গবেষক গঙ্গাপ্রসাদ বিমল, কলকাতার কবি মন্দাক্রান্তা সেন ও আবুল মোমেন। সপ্তম অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘অন্য দেশে অন্য জীবন প্রবাসচিত্র’। কায়সার হকের সভাপতিত্বে মূল বক্তা ছিলেন ভারতের লেখক ও গবেষক অমিয় দেব। আলোচনা করেন ভারতের লেখক আশিস সান্যাল, নেপালের গল্পকার মহেশ পদওয়াল ও ভারতের গীতিকবি শতরূপা সান্যাল। ‘সাহিত্য থেকে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে সংযোজন এবং পরিক্রমা’ শীর্ষক সভার মূল বক্তা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সসভাপতি শাঁওলী মিত্র। আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক ও কবি আনিসুল হক, ভারতের লেখক অংশুমান ভৌমিক, বাংলাদেশের লেখিকা ফৌজিয়া খান ও লেখক জাকির হোসেন রাজু। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় লোকসাহিত্যবিষয়ক নবম অধিবেশনটি। এতে মূল বক্তা ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান। কবি আসাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা করে গবেষক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, লোকসংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া ও তরুণ লোক-গবেষক সুমন কুমার দাশ। সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত দশম অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘আজকের শিল্পভাষা : আর্ট, পারফরম্যান্স ও কবিতায় নির্মাণ’। ভারতের বিখ্যাত শিল্পী গণেশ হালুইয়ের সভাপতিত্বে মূল বক্তা ছিলেন ভারতের চিত্রকলাবিষয়ক লেখক সুশোভন অধিকারী। আলোচনা করেন দেশবরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পতাত্ত্বিক আবুল মনসুর ও শিল্পী ঢালী আলী মামুন। বিকেল পর্যন্ত চলমান সাহিত্য সম্মেলন শেষে সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি উৎসব বর্ণিল হয়ে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বের শুরুতেই হাসন রাজা মঞ্চে গম্ভীরা গান শোনান আতাউর রহমান মিন্টু ও তাঁর দলের সদস্যরা। সুরেলা কণ্ঠের সুরসুধায় সেকালের বাংলা গান শোনান কণ্ঠশিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ান। গেয়ে শোনান ‘যদি কাগজে লিখো নাম, সে নাম মুছে যাবে..’সহ কয়েকটি গান। সেকালের গান শেষে নজরুলের গান নিয়ে মঞ্চে আসেন খায়রুল আনাম শাকিল। পরিবেশন করেন জাতীয় কবির সৃষ্ট গজল, ঠুমরি, লোকসুর ও কাব্যগীতিসহ নানা আঙ্গিকের গান। ভরাট কণ্ঠের মাধুর্যে শ্রোতাদের আলোড়িত করে গেয়ে শোনান ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’সহ কয়েকটি নজরুলসঙ্গীত। সব শেষে ছিল লোকগানের পরিবেশনা। শেকড়ের গান শুনিয়ে শ্রোতাদের অন্তরে প্রশান্তির পরশ ছড়িয়ে দেন লাবিক কামাল গৌরব, নবনীতা চৌধুরী ও বেবি দেওয়ান। এছাড়াও উৎসবের চতুর্থতম দিনের সন্ধ্যায় সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নাটক ‘আমিনা সুন্দরী’। নাট্যকার এস এম সোলায়মানের রচিত প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন রোকেয়া রফিক বেবী। চট্টগ্রামের অমর লোককাহিনী নছর মালুম ও ভেলুয়া সুন্দরী অবলম্বনে এ নাটকটি রচিত হয়েছে। আজকের আয়োজন : আজ রবিবার শেষ হবে সাহিত্য সম্মেলন ॥ সম্মেলনের শেষ দিনে রয়েছে তিন পর্বে কবিতাপাঠের অধিবেশন। এসব অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন কবি রুবী রহমান, আসাদ চৌধুরী ও রবিউল হুসাইন। স্বরচিত কবিতাপাঠ করবেন কবি মুহাম্মদ সামাদ, তারিক সুজাত, শতরূপা সান্যাল, বীথি চট্টোপাধ্যায়, রুবী রহমান, শিহাব সরকার, হাবীবুল্লাহ সিরাজীসহ বাংলাদেশ ও ভারতের একঝাঁক কবি। সন্ধ্যায় রাজা মঞ্চে পরিবেশিত হবে নীলাঞ্জনা দাশত পরিচালিত নৃত্যানুষ্ঠান ‘দ্রোহকাল’। এরপর সরোদ বাজিয়ে শোনাবেন বাদন করবেন রাজরূপা চৌধুরী এবং রবীন্দ্রসংগীত ও তিন কবির গান পরিবেশন করবেন শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা। সবশেষে পালাগান পরিবেশন করবেন কুদ্দুস বয়াতি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ উৎসব চলবে ৩ মার্চ পর্যন্ত। জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাককে উৎসর্গীকৃত এবং ইনডেক্স গ্রুপ নিবেদিত উৎসবের সহযোগিতায় রয়েছে ঢাকা ব্যাংক। সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল আই।
×