ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জেএসসি জেডিসি পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণ

বদলে গেল তিন হাজার পরীক্ষার্থীর ফল-জিপিএ-৫ পেল ৮শ’

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

বদলে গেল তিন হাজার পরীক্ষার্থীর ফল-জিপিএ-৫ পেল ৮শ’

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণে সকল বোর্ডেই এবার ফলে অসংখ্য ভুল ধরা পড়েছে। অনলাইনে খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদনের পর অষ্টম শ্রেণীর এ সমাপনী পরীক্ষায় পরিবর্তন হয়েছে রেকর্ডসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফল। পুনঃনিরীক্ষণে তিন হাজারেরও বেশি পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে, যাদের প্রত্যেকেরই ফল আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। আগে ফেল হলেও নতুন করে পাস করেছে সাত শতাধিক পরীক্ষার্থী। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে আট শতাধিক পরীক্ষার্থী। ফেল থেকে পাস ও জিপিএ-৫ এ দুটি ক্ষেত্রেই সংখ্যায় বেশি পরিবর্তন হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। এখানে ফল পরিবর্তন হয়েছে এক হাজার ৫৭৮ শিক্ষার্থীর। জানা গেছে, ইতোমধ্যেই খাতা পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। শনিবার রাত থেকে বোর্ডগুলো স্ব-স্ব ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ শুরু করেছে। পুনঃনিরীক্ষণের আবেদনের সময় দেয়া টেলিটক মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও ফল জানা যাচ্ছে। এর আগে আটটি সাধারণ, একটি মাদ্রাসা (কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এ স্তর নেই) বোর্ডের এ পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল না পেয়ে এবার অসংখ্য শিক্ষার্থী উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে। প্রত্যেক বোর্ডেই তিন হারেরও বেশি শিক্ষার্থী ফলাফলে আপত্তি জানিয়ে আবেদন করে। এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। রীতিমতো অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে এ স্তরের পরীক্ষার্থীরা। তারা ছাড়িয়ে গেছে আগের সব সাফল্যকেই। সাধারণ শিক্ষার জেএসসি ও মাদ্রাসার জেডিসি পরীক্ষায় পাস করেছে ৯৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। আগের বছর যা ছিল ৯২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৩২৫ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৮ জনে। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে সারাদেশের মোট ২৮ হাজার ৭৪১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯৫৯ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পাস করে ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭৫ জন, ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৬ জন ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে পাস করেছে ১৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৯৬ জন। পাসের হার ৯২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জেএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট দুই লাখ ৩৫ হাজার ৫৯ জন। মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে জেডিসি পরীক্ষায় পাসের হার ৯৪ দশমিক ০২ শতাংশ। জেডিসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ৫২৯ জন। তবে ফলাফলের এ অভাবনীয় সাফল্যের মধ্যেই নিজেদের ফল নিয়ে আপত্তি তোলে বিভিন্ন বোর্ডের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে টেলিটকের সঙ্গে সমন্বয় করে সহজ প্রক্রিয়াও রাখা হয়। ফলে ফল নিয়ে আপত্তি তোলা শিক্ষার্থীরা সহজেই অনলাইনে তাদের আপত্তির তথ্য জানাতে পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, জেএসসিতে এবারের আবেদনের সংখ্যা অন্য যে কোন বছরের তুলনায় বেশি। জানা গেছে, ফল প্রকাশের পর থেকেই ছিল অনলাইনে খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদনের সুযোগ। আবেদন গ্রহণ করে এখন পর্যায়ক্রমে ফল প্রকাশ করছে বোর্ডগুলো। যেখানে ফলাফলের ব্যাপক পরিবর্তনের চিত্রই ধরা পড়েছে। শনিবার শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিসে আলাদা আলাদাভাবে টেলিফোনে যোগাযোগ করে ফল পরিবর্তনের তথ্য পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও স্ব স্ব বোর্ডে গিয়ে ফল জানতে পারছেন। খাতা পুনঃনিরীক্ষণ শেষে ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফল প্রকাশের পর ঢাকা বোর্ডেই ২৬ হাজার ৮৮৫ জন সংক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে। এই বোর্ডেই ফল পরিবর্তনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ বোর্ডের পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও অবশ্য বেশি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ফল পরিবর্তন হয়েছে এক হাজার ৫৭৮ জনের। আগের ফলাফলে ফেল দেখানো হলেও এখন পাস করেছে ২৩৮ জন। আগে জিপিএ-৫ এর কম পেলেও আপত্তি জানিয়ে এখন জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪০৬ জন পরীক্ষার্থী। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডেও পরিবর্তন হয়েছে অনেক পরীক্ষার্থীর ফল। এখানে মোট ২৭৫ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ- ৫ পেয়েছে ৪৬ জন। এছাড়া আগে ফেল করলেও আপত্তি তুলে পাস করেছে ৫৪ জন পরীক্ষার্থী। মাদ্রাসার জেডিসিতে ফল নিয়ে আপত্তি তুলেছিল চার হাজার ৬৪৬ জন। যাদের মধ্যে আপত্তি জানিয়ে ফল পরিবর্তন হয়েছে ২৬৯ জনের। আগে ফেল করলেও এখন পাস করেছে ১৫৩ জন। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৫ জন। যশ্রো শিক্ষা বোর্ডে ফল পরিবর্তন হয়েছে ২০৫ জনের। ফেল থেকে পাস করেছে ৪৫ জন। এছাড়া নতুন করে জিপিএ৫ পেয়েছে ১২২ জন ভাগ্যবান পরীক্ষার্থী। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডেও ফল পরিবর্তন হয়েছে। এখানে ৬ হাজার ৬২০ জন ফল নিয়ে আপত্তি জানায়। ফল পরিবর্তন হয়েছে ৯২ জনের। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৬ জন। ফেল থেকে পাস করেছে ১২ জন পরীক্ষার্থী। সিলেট বোর্ডের চিত্রও একই। এখানে পরিবর্তন হয়েছে ১৪৬ জনের। ফেল থেকে পাস করেছে ৪২ জন, নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৬ জন, জিপিএ পরিবর্তন হয়েছে ১৬ জনের। বোর্ডগুলো বলছে, এভাবে রাজশাহী, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ অন্যান্য বোর্ডের প্রায় একই হারে ফল পরিবর্তন হয়েছে খাতা পুনঃনিরীক্ষণে। ভুল ধরা পড়া সম্পর্কে প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা। তারা বলেছেন, সবচেয়ে বেশি ভুল পাওয়া গেছে বৃত্ত ভরটে। যেমন দেখা গেছে, একজন ৮৫ পেয়েছে সেখানে উল্টো ৫৮ বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে। আবার দেখা গেছে, ১৩টি প্রশ্নের উত্তর দিল কেউ। একটির উত্তরের নম্বর হয়ত মোট নম্বরের সঙ্গে যোগই করা হয়নি। কোন কারণে হয়ত যোগ করার সময় ১২টি প্রশ্নের উত্তরের প্রাপ্ত নম্বর যোগ করা হয়েছে। এখন ঠিকভাবে যোগ করার সময় পরীক্ষার্থীর মোট নম্বরও বেড়ে গেছে। কিন্তু কেন বিশাল এই সংখ্যা পরিবর্তন? এই প্রশ্নের উত্তরের সংশ্লিষ্ট সকলেই বলছেন, তাড়াহুড়া করে ফল প্রকাশের কারণেই খাতায় ব্যাপক ভুল হচ্ছে। যার মূল্য দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মূলত তিন ধরনের ভুল ধরা পড়েছে। এক, কিছু খাতায় নম্বরের যোগ ফল ঠিক ছিল না। দুই, কিছু উত্তরের নম্বর যোগ করা হয়নি। আর তিন, ওএমআর ফরমে বৃত্ত ভরাটেও ভুল। এদিকে দ্রুত ফল প্রকাশের ফলে ভুল হওয়া বা সাধারণ কিছু ভুল হওয়াকে স্বাভাবিক বললেও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলছেন, ফলের এ পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বড় কারণ শিক্ষকদের গাফিলতি। কারণ কিছু ভুল মানুষের হতেই পারে। অনেক কাজ করতে গেলে কিছু ভুল হয়। তবে যেটা একেবারেই মানা অগ্রহণযোগ্য সেই ভুল মানা যায় না। এবার আমরা বিষয়টি নিয়ে শক্ত অবস্থানে যাব। তবে সমস্যাও আছে। কিছু করতে গেলেই নানা আপত্তি। দেখ্ াযাবে কঠোর হব কাজই করতে চাবেন না অনেকে। দেখা যাক এবার আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চাই। এদিকে জানা গেছে, পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সন্দেহকে সঠিক বলে মত দিয়েছিল সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ দল। তাই পরীক্ষা পদ্ধতিকে অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে খাতা পুনঃনিরীক্ষণের (রিস্ক্রটিনি) পরিবর্তে খাতা পুনর্মূল্যায়নের (রিএক্সামিন) সুপারিশ করা হয়েছিল। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পারফরমেন্স ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে (পিআইপি) ৫টি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত গবেষক দল তাদের প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করেছিল। প্রতিবেদনে পদ্ধতিটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে দায়িত্বে অবহেলা অথবা অসদাচরণের জন্য পরীক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ ১৩টি সুপারিশ করা হয়। বিষয়টিকে সমর্থন করেন শিক্ষবিদরাও। তবে খাতা পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর খাতা পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষা বোর্ডের চেয়াম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা। তারা বলছেন, এখন খাতা পুনর্নিরীক্ষণে দেখা হয় কোন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর যোগ করায় কোন ভুল হয়েছে কিনা? অথবা প্রাপ্ত নম্বর লেখায় কোন ভুল হলো কিনা? বর্তমান যে পদ্ধতি আছে তাতেই সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে। গবেষকরাও তেমন কোন অসঙ্গতি পায়নি। একবার খাতা দেখে ফল প্রকাশ করতেই দুই মাস লাগে। তার পরে আপত্তি করা খাতা আবার দেখতে হলে ফল প্রকাশ করতেই কয়েক মাস চলে যাবে।
×