ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভুল কম্পিউটার অপারেটরের

খেসারত দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

খেসারত দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আজও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য। দীর্ঘদিন পর বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করার জন্য সারাদেশ থেকে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেন। সেক্ষেত্রে কম্পিউটার অপারেটরদের ভুলে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আবেদনকারীর ডিজি নাম্বার না আসায় যাচাই-বাছাইয়ের পূর্বে তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। ফলে এবারও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। সূত্রমতে, দেশ মাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আব্দুস ছত্তার হাওলাদার। নিজের জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ২০১১ সালে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার জঙ্গলপট্টি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছত্তার হাওলাদারের অসহায় বিধবা স্ত্রী আছিয়া বেগম জানান, মুক্তিযুদ্ধের সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডারের দাবিকৃত মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দিতে না পারায় তার স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি আরও জানান, তার স্বামীর নাম গেজেটভুক্ত করার জন্য তিনি অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কম্পিউটার অপারেটরদের ভুলে আবেদনের ডিজি নাম্বার আসেনি। ফলে তিনি এখন চরম বিপাকে পড়েছেন। আব্দুস ছত্তার হাওলাদার ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমলানী যুব শিবির নিয়ন্ত্রণ পরিষদে ভর্তি হন (আইডি নং-১৮০৪৩)। পরবর্তীতে তিনি ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ও মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত বাহিনীর অধীনে বিভিন্নস্থানে সক্রিয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেন (এফএফ নং-৬২৩)। একইভাবে জঙ্গলপট্টি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদুত গোস্বামী অনলাইনে আবেদন করা সত্ত্বেও কম্পিউটার অপারেটরের ভুলের কারণে সাবমিট না করায় তারও ডিজি নাম্বার আসেনি। ফলে তিনিও চরম বিপাকে পড়েছেন। গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু বলেন, অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা অনলাইনে আবেদন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। ফলে কম্পিউটার অপারেটররা আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবারকে আবেদনের যে কপি ধরিয়ে দিয়েছে তাই সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। এখন যাচাই-বাছাইয়ের পূর্বে ওইসব মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা অনলাইন আবেদনের কপি নিয়ে এলে দেখা যায় তাদের আবেদন সাবমিট না করায় ডিজি নাম্বার আসেনি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কমান্ডার বুলেট ছিন্টু আরও জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গৌরনদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক ছিলেন বড়কসবা গ্রামের তৎকালীন পাকিস্তানের সেনা সদস্য আব্দুল হক। তিনি ছুটিতে বাড়িতে আসার পর পরই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীতে আব্দুল হক কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে দেশ মাতৃকারটানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও আজও তার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। তিনিও অনলাইনের সমস্যায় পড়েছেন। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিনেও তালিকাভুক্ত হতে না পেরে সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেন গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের কাঞ্চন বেপারি, একই গ্রামের শাজাহান আকন ও আনোয়ার হোসেন, বংকুরা গ্রামের জাকির হোসেন বেপারি, শিঙ্গা গ্রামের পুত্র আব্দুল মালেক ফকির, উজিরপুর উপজেলার উত্তর শোলক গ্রামের নজরুল সরদার, কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামের আবুল কাশেম খান, বানারীপাড়া উপজেলার লবণসাড়া গ্রামের মোক্তার হোসেন, আগৈলঝাড়া উপজেলার পশ্চিম বাগধা গ্রামের অজিত মধু, গৌরনদীর কান্ডপাশা গ্রামের মোজাম্মেল হক, বংকুরা গ্রামের আক্কেল আলী বেপারি, একই গ্রামের আব্দুল হাকিম বেপারি, আধুনা গ্রামের আকবর আলী আকন, একই গ্রামের আকবর মোল্লা, পশ্চিম চন্দ্রহার গ্রামের আবুল হোসেন হাওলাদার, বাটাজোর হরহর গ্রামের ওসমান গনি, বাবুগঞ্জের জাহাপুর গ্রামের আলী হোসেন বেপারিসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। অপরদিকে উজিরপুর উপজেলায় ১২ মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া যুদ্ধাহত হিসেবে প্রতিমাসে অর্ধলাখ টাকা ভাতা তোলার অভিযোগ করেছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড। সূত্রমতে, উজিরপুরে এক বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭৯৪ ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার বাইরে ৩০ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। গেজেটভুক্ত ৮৩০ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন পন্থায় ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা গ্রহণসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এ পর্র্যন্ত উজিরপুরে ৪৭৬টি ডিজি নম্বরযুক্ত আবেদনপত্র পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ সরদার, ডেপুটি কমান্ডার হারুন-অর রশিদ, সাবেক কমান্ডার আব্দুল মতিন সরদার নান্টুসহ একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, উজিরপুরে কোন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নেই। কিন্তু কিভাবে ১২ যুদ্ধাহত মুুুুক্তিযোদ্ধা ভাতাগ্রহণ করছে তা আমাদের জানা নেই। পার্বতীপুরে শহীদ ডাক্তার শ.আ.ম হায়দার পার্বতীপুর থেকে জানান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডাক্তার আঃ গফুরের ৪৫ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। পার্বতীপুর কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় কর্মরত তার ছেলে বদিউজ্জামান আহম্মদ বাবাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে রাষ্ট্রীয় গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তি করে ছেলে-সন্তানদের সম্মানী ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্থানীয় ইউএনওর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে তিনি ছিলেন পার্বতীপুর রেলওয়ে হাসপাতালের এ্যাসিসটেন্ট সার্জন। তার আগে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ, বেনারপাড়া, লালমনিরহাট, পাহাড়তলী ও ঢাকা রেল হাসপাতালে মেডিক্যাল ডাক্তার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চলমান অসহযোগ আন্দোলনে দেশের অবস্থা যখন উত্তাল তখন পালাতে গিয়ে স্ত্রী, ছেলে-সন্তানসহ পার্বতীপুরে আটকা পড়েন। তবে জয়বাংলার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত এমবিবিএস পাস এই তরুণ ও মেধাবী ডাক্তার বসে থাকেননি। মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের তথ্য পাচার, সংবাদ আদান-প্রদানসহ নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। টের পেয়ে পাকী বাহিনীর অন্যতম দোসর অবাঙালী নেতা সোয়েব কামরুজ্জামান,বাচ্চু খাঁন তাকে একাত্তরের ১০ মে রাতে পার্বতীপুরের রেল বাংলো বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। সোয়েব বিল্ডিংয়ের টর্চাল সেলে অমানবিক নির্যাতন করে শেষে জীবিত অবস্থায় দেহ খ--বিখ- করে জ্বলন্ত স্টিম ইঞ্জিনের বয়লারে নিক্ষেপ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীনের পরে ডাক্তারের পরিবার চরম দুর্দিনের মধ্যে পড়ে। তার স্ত্রী আছিয়া খাতুন বক্ষব্যাধি রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিনা চিকিৎসায় মারা যান। প্রথম সন্তান মমতাজ বেগম মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবিত রয়েছে দুই ছেলে ও ৫ মেয়ে। এতদিনেও কেউ এই শহীদ পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়নি বলে আক্ষেপ করে বলেছেন শহীদের সন্তানরা। তবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক ও মেডিক্যাল ছাত্র স্মৃতিফলকে তার নাম ঢাকা মেডিক্যালের প্রবেশ দ্বারে শোভা পাচ্ছে। এই ফলক উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×