ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা, অর্থপ্রাপ্তি চ্যালেঞ্জিং ;###;জাপানসহ একাধিক দেশ ও দাতা সংস্থার সঙ্গে অর্থ সহায়তার আলোচনা চলছে

দেড় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ॥ আসছে বুলেট ট্রেন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

দেড় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ॥ আসছে বুলেট ট্রেন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড ট্রেন (বুলেট) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে চলবে নতুন এই বুলেট ট্রেন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে রেলপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব কমবে ৯০ কিলোমিটার। তবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর বৈদেশিক অর্থায়নের প্রয়োজন। এ নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেই বুলেট ট্রেন চালুর কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এ ধরনের রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ বাংলাদেশে প্রথম। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরী বলেও মনে করেন তারা। রেল কর্মকর্তারা জানান, যোগাযোগ খাতের এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জিং। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অর্থের সংস্থান। যদিও জাপানের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে বিকল্প হিসেবেও একাধিক দেশ ও দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে । প্রথমে লাকসাম হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেন চালু হবে। তবে তার আগে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী পেতে হবে। অর্থের নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই বুলেট ট্রেনের রেলপথ নির্মাণের গতি বাড়বে। রেল মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুটের একটি। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৩২০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা থেকে টঙ্গী-ভৈরব বাজার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছে। ফলে রেল ভ্রমণে ৭ থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে। ঢাকা থেকে কুমিল্লার লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড ট্রেন লাইন নির্মিত হলে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব ও সময় প্রায় দুই ঘণ্টা কমবে। তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব দাঁড়াবে ২৩০ কিলোমিটার। এ পথে ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে। ফলে ঢাকা থেকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে চট্টগ্রামে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের নির্দেশ দেন। তখন থেকেই প্রকল্পের ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল) তৈরির কাজ শুরু করে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে কয়েক দফা পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভাও হয়েছে। বুলেট রেলপথ নির্মাণে সমীক্ষা প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের নবেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য সমীক্ষা প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে। জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণেরও একটি সম্ভাব্য সমীক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। বুলেট রেলপথটি এ এক্সপ্রেসওয়ের পাশ দিয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনটি সম্ভাব্য রুট নির্ধারণ করা হয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য। এর মধ্যে মদনপুর (ঢাকা)-দাউদকান্দি-কুমিল্লা-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম রুটের দৈর্ঘ্য ২১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। মদনপুর (ঢাকা)-দাউদকান্দি-বরুড়া-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম রুটের দৈর্ঘ্য ২০৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং মদনপুর (ঢাকা)-দাউদকান্দি-চাঁদপুর-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এই রুটের দৈর্ঘ্য ২৮০ কিলোমিটার। এ তিনটি রুটের মধ্যে দূরত্ব কম হওয়ায় মদনপুর (ঢাকা) দাউদকান্দি-বরুড়া-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান রেলমন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রেলপথ হচ্ছে একটি নিরাপদ আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী মাধ্যম। রেলের মাধ্যমে আমরা জাতিকে আরও সেবা দিতে চাই। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি আমলে রেল একটি অবহেলিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় করে দিয়েছেন। আরও অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা চালু করব বুলেট ট্রেন। মন্ত্রী বলেন, সড়ক নিরাপত্তা ও সাশ্রয়ী বিবেচনায় মানুষ দিন দিন ট্রেন ভ্রমণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রতিদিনই রেলপথে যাত্রী বাড়ছে। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন রেলপথে প্রতিদিন এক লাখ ৬০ হাজার থেকে এক লাখ ৭০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হতো। এখন আড়াই লাখ যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। রেলপথের সমস্যা অনেক কমে এসেছে। বাকি যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোরও সমাধান করব। রেল কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডর ব্যবস্যা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবদিক বিবেচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহেশখালী ঘিরে জ্বালানি এবং বিদ্যুত হাব গড়ে তোলা হচ্ছে। এ কারণে প্রচুর দেশী-বিদেশী নিয়মিত ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাবেন। এর ওপর এ রুটে যাত্রীর চাপ বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী বুলেট ট্রেন প্রকল্প নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, বুলেট ট্রেন চালু করতে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন। ভারতও মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ বুলেট ট্রেন করতে ৬৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েও অর্থায়ন এবং জমি সংকটে হোঁচট খেয়েছে ভারত। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও একবার পাতাল রেলের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় রেলওয়ে। তবে দেশের অর্থনীতি এখন অনেক বড়। সরকার আন্তরিক হলে এ রকম বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সফলভাবে বুলেট ট্রেন চালু করতে পারলে এটিকে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণে সুযোগ থাকবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে উচ্চগতির ট্রেন চললে সম্ভাব্য যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এতে পর্যটকরা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছতে পারবেন। এতে পর্যটন খাত দ্রুত প্রসার লাভ করবে। বুলেট ট্রেনে রেলপথের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইনের লক্ষ্যে এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ১০৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে চলতি বছরের অক্টোবর থেকে। দুই বছর মেয়াদে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইনের কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পটি সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হবে। বুলেট ট্রেনের লাইন নির্মাণে চীনের সঙ্গে জি-টু-জি ভিত্তিতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।
×