ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যন্ত গ্রামে এক বিরল স্কুল

শতভাগ জিপিএ-৫, আছে পাঠাগার জাদুঘর

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

শতভাগ জিপিএ-৫, আছে পাঠাগার জাদুঘর

সমুদ্র হক ॥ শিশুদের সুন্দর জীবন গড়তে সাফল্যের বৈঠা বেয়ে নিভৃত এক গ্রামে শিক্ষার এক তরণী এগিয়ে চলেছে। যা নগর-মহানগরের অনেক স্কুলকে পিছনে ফেলেছে। শিশুদের শিক্ষার ভিত শক্তিশালী করতে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি ইমাজিনেশন বাড়াতে বই পড়াসহ নানা কার্যক্রম স্কুলের রুটিনে যোগ করা হয়েছে। বেড়েছে শিশুদের মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা। মাঠ পর্যায়ের এই স্কুলের নাম আমতলী মডেল স্কুল। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ সদর উপজেলার আমতলী গ্রামে স্কুলের অবস্থান। এই স্কুল প্রমাণ করেছে শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে মেধাবী ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সততার সঙ্গে সামান্য উদ্যোগই যথেষ্ট। গত কয়েক বছর ধরেই এ স্কুল প্রাথমিক শিক্ষা পরীক্ষা (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় অসাধারণ ফল এনে দিয়েছে। এ বছর জেএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা শতভাগ জিপিএ-৫, এ-প্লাস অর্জন করে সারাদেশে তাক লাগিয়েছে। একই রকম ফল করেছে পিইসি পরীক্ষার শিক্ষার্থীরা। এই প্রায় ধারাবহিকতা অব্যাহত রয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে নিয়ামানুবর্তিতা- নিয়মিত পাঠাভ্যাস অধ্যাবসায় এবং স্কুলের শিক্ষকদের পাঠদানে একাগ্রতা সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। গ্রামের এই স্কুলে নিয়মিত পাঠদানের পাশাপশি বাড়তি ক্লাস নেয়া, পাঠক্রম বহির্ভূত জ্ঞান অন্বেষণে পাঠাগারে বই পড়া, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানা, বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে জানা, দেশের ঐতিহ্য ও বাঙালীর বিলুপ্তপ্রায় জিনিস দেখা ও জানার বিষযগুলো রুটিনে সংযোজন করা হয়েছে। এই স্কুলেই কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে গ্রাম বাংলার বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের একটি জাদুঘর। স্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল বেশি দিনের নয়। মাত্র ২৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি এই স্কুলের যাত্রা শুরু। এলাকার শিক্ষানুরাগী মীর লিয়াকত আলী গ্রামের অবহেলিত শিশুদের শিক্ষার মানকে উন্নত করতে উদ্যোগ নেন। নিজের জমির ওপর প্রথমে প্রতিষ্ঠা করেন আমতলী প্রি-ক্যাডেট স্কুল। কিছুদিন পর স্কুলের নাম পাল্টে রাখা হয় আমতলী মডেল স্কুল। গ্রামের স্কুলের শিশুদের উন্নত পাঠদানে মেধাবী শিক্ষদের নিয়োগ দেয়া হয়। স্কুলকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সর্বক্ষণিক দায়িত্ব দেয়া হয় দু’জন পরিচালককে। তারা হলেন মীর মহরম আলী ও জেবুন নাহার কলি। স্কুল কম্পাউন্ডে প্রতিষ্ঠা করা হয় ভাষা সৈনিক বাহাউদ্দীন চৌধুরী পাঠাগার। এই পাঠাগার স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গ্রামের সকলের জন্য উন্মুক্ত। পাঠাগারের বই পড়লে দেয়া হয় নগদ টাকা। পাঠাগারের সঙ্গেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ ৬শ’ প্রতিকৃতি টাঙ্গানো আছে। যাদের মধ্যে আছেন বিজ্ঞানী, নোবেলে বিজয়ী, বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, খেলোয়াড়, শিল্পীসহ অনেকে। পাঠাগারের কাছেই স্থাপিত হয়েছে গ্রামীণ ঐতিহ্য বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শনের জাদুঘর। মাঠ পর্যায়ের স্কুলে এমন মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি বিরল। শিক্ষার্থীদের সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় জাদুঘর প্রতিকৃতি ও বইয়ের নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আলোকিত কোন ব্যক্তিত্বদের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করা হয়। কম্পিউটারের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রতিদিন হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান অন্বেষণের লক্ষ্যে রুটিনে পাঠক্রমের বাইরে নানা কিছু যোগ করা হয়েছে। শরীরচর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিবছর ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা শিশুদের মননশীলতা সংস্কৃতি বিকাশে বড় ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষার্থীদের হাতের লেখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর হাতের লেখা সুন্দর। শিক্ষার্থী পরিবহনে স্কুলের রয়েছে মোটরযানসহ রিক্সা ভ্যান। দূরের শিক্ষার্থীদের মোটরযানে পরিবহন করা হয়। ক্লাস শেষে স্কুল মাঠে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা আছে। স্কুল মাঠে বসানো হয়েছে খেলাধুলার উপকরণ। ২৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যে স্কুলের যাত্রা শুরু বর্তমানে প্লে ক্লাস থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫শ’ জন। প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেনসহ শিক্ষকের সংখ্যা ২৪ জন। স্কুলের শিক্ষার উন্নত মান দেখে এলাকার অভিভাবকগণ দাবি করেছেন নবম ও দশম শ্রেণীর ক্লাস শুরুর। ক’জন অভিভাবক জানালেন, শিক্ষার্থীরা একটি ভাল স্কুল থেকে পাঠগ্রহণ করে ভাল ফলের পর এলাকায় উন্নতমানের মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় বিপাকে পড়তে হয়। নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে আমতলী মডেল স্কুল থেকে পাঠগ্রহণ করে জেএসসিতে ভাল ফল করে অন্য স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে এ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। যে কারণে অভিভাবকগণ আমতলী মডেল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার কাছে আবেদন জানিয়েছেন নবম শ্রেণী চালুর। এই স্কুলেই নবম শ্রেণীতে উঠে শিক্ষার্থীরা যেন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল করে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি সরকারের মন্ত্রীরা এই স্কুল পরিদর্শন করেছেন একাধিকবার। তারা প্রত্যেকেই প্রত্যন্ত গ্রামের এমন স্কুল ও ফল দেখে মুগ্ধ। বিশেষ করে স্কুলের পাঠাগার ও জাদুঘর শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়তি জ্ঞান এনে দিচ্ছে। শিশুমনে ইমাজিনেশন পাওয়ার গড়ে উঠছে। প্রত্যন্ত গ্রামে এমন উন্নতমানের স্কুল বিরল।
×