ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবি থেমে নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবি থেমে নেই

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার জন্য আহ্বান জানালেও এখনও পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সাড়ে চার দশক পরেও পাকিস্তানের ভিতর থেকে সে সময়ের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি থেমে নেই। বিশেষ করে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার জন্য দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের প্রতি ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। তবে পাকিস্তান বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বিশেষ করে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খার ২০১২ সালে ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ দেশটির প্রতি ক্ষমা চাওয়ার জন্য দাবি তোলে। তবে সে সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অতীতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগোনোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এদিকে ২০০২ সালে পাকিস্তানের ৫১টি বেসরকারী সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য আহ্বানও জানানো হয়েছিল। তবে পাকিস্তান সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম সে সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি ঘটনায় অনুশোচনা করে বাংলাদেশের কাছে ইতোমধ্যেই ক্ষমা চেয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের তরুণরা। গত বছর থেকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি পিটিশনে সই অব্যাহত রেখেছেন তারা। পিটিশনে অনেক তরুণ বলেছেন, সে সময় জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। ‘পাকিস্তানী হিসেবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাই’ শীর্ষক পিটিশনে ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের পাঁচ শতাধিক তরুণ সই করেছেন। সেখানে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন তারা। পিটিশনের পাশাপাশি সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকেও পাকিস্তানী হিসেবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাই শিরোনামে একটি পেজ খোলা হয়েছে। সেখানেও ক্ষমা চেয়ে সই অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তানী তরুণ ইমাদুদ্দিন আহমেদ এই পিটিশনের উদ্যোক্তা। ইমাদুদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের তরুণরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। পাকিস্তানের সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য তাদের দেশের সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীর ঢাকায় এসে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে এ দেশে যা হয়েছিল, তা অবশ্যই গণহত্যা। আমার বাবা (ওয়ারিস মীর) ও তাঁর সফরসঙ্গীরা পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে এ কথা তুলে ধরার পর তাঁদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়। তাঁদের দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের অনেকেই বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে। তবে এর ঘোর বিরোধী জামায়াতের মতো কিছু দল। পাকিস্তানের ডন পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক সেলিম শেখ বলেছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর অপকর্মের জন্য আমরা এখনও দুঃখ বোধ করি। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের অপকর্মের জন্য আমাদের সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। একই মত পোষণ করে পাকিস্তান টুডের সাংবাদিক আমর গুরিরো বলেন, ১৯৭১ সালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী যারা এখনও জীবিত রয়েছেন পাকিস্তান বাহিনীর সেই সব সদস্যদের পাকিস্তান সরকারের একটি প্রতীকী বিচার করা উচিত। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সব পাকিস্তানী সৈন্য অপরাধ করেছিল এখনও তাদের বিচার করার সুযোগ রয়েছে। কারণ ৬২ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের এখন বিচার হচ্ছে। পাকিস্তানের দি নেশন পত্রিকার সাংবাদিক রমজান চান্দিয়ো ১৯৭১ সালে তাদের সৈন্যদের কর্মকা-কে অমানবিক আখ্যা দিয়ে একে পাকিস্তানের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশে অপকর্মের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে জাতীয় পরিষদে একটি বিল উত্থাপনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এই ভেবে অবাক হন যে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের ভাইদের ওপর কিভাবে এত ব্যাপক একটি হত্যাকা- ঘটিয়েছে এবং কিভাবে অপরাধীরা শাস্তি না পেয়ে পার পেয়ে যায়। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিভিত্তিক একটি বেসরকারী সংস্থার এনজিও কর্মী সুমাইরা গুল বলেছেন, পাকিস্তানী বাহিনী তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সাধারণ লোককে ভুল বোঝানোর জন্য তারা প্রচারণা চালায় যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ (১৯৭১) হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ পরে সত্য জানতে পারে এবং বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে গণহত্যার জন্য আর বিলম্ব না করে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য তিনিও তার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
×