ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর বিমানের জরুরী অবতরণ নিয়ে ৩ তদন্ত কমিটি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

প্রধানমন্ত্রীর বিমানের জরুরী অবতরণ নিয়ে ৩ তদন্ত কমিটি

আজাদ সুলায়মান ॥ ইঞ্জিনের একটি নাট ঢিলা হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এতে দ্রুত তেল পড়ে যাওয়ায় বার বার বিপজ্জনক সিগন্যাল দেখা দেয়ায় জরুরী অবতরণ করতে বাধ্য হন ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন। ওই ফ্লাইটের মেনটেন্যান্স লগ বুকে এমনই কারণই উল্লেখ করেছেন ক্যাপ্টেন। এ ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা থেকে হাঙ্গেরি যাবার পথে তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদে জরুরী অবতরণ করা ফ্লাইট রাঙ্গা প্রভাত সোমবার ঢাকায় ফিরেছে। এদিকে বিমানের আরও একটি ফ্লাইট সোমবার দু’দফা যান্ত্রিক ত্রুটির দরুন ঢাকা-কলকাতা ফ্লাইট নিয়ে বিপর্যয় দেখা দেয়। একের পর এক বিমানে এ রকম ত্রুটি দেখা দেয়ায় প্রশ্ন উঠেছে প্রকৌশল বিভাগের ভূমিকা নিয়ে। ভিভিআইপি ফ্লাইটের এহেন ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিমান মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি। সোমবার কমিটির বৈঠকে বিমান নিয়ে নতুন করে ভাবার জন্য মতামত দিয়েছেন একজন সদস্য। বিমান জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ওই ফ্লাইট রাঙ্গা প্রভাত আশখাবাদ থেকে বুদাপেস্টে নিরাপদে অবতরণের পর সেটা আবুধাবী হয়ে সোমবার বেলা দুটোয় ঢাকায় ফিরে এসেছে। বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন শেখ নাসের ওই ফ্লাইট নিয়ে আবুধাবী থেকে চট্টগ্রাম হয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সোমবার বিমানের ফ্লাইট অপারেশনে গিয়ে দেখা যায়, আশখাবাদে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট জরুরী অবতরণের জন্য প্রাথমিকভাবে ইঞ্জিনের একটি নাট ঢিলা হওয়াকেই দায়ী করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ইসমাইল রাঙ্গা মেনটেন্যান্স লগ বুকে লিখেছেন, ইঞ্জিনে ওয়েল প্রেসার কমে যাওয়ার দরুন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। আশখাবাদে সেটা মেরামতের সময় দেখা যায় একটি নাট ঢিলা অবস্থায়। এ কারণেই ওয়েল (মোবিল) পড়ে যাওয়ায় চাপ কমে যায়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমানের বাঁ দিকের ইঞ্জিনের ‘ইঞ্জিন অয়েল’ কমে যাওয়ায় ওই ঘটনা ঘটে। পাইলটরা বেশ কিছুক্ষণ আগে বিষয়টি ধরতে পারেন। ককপিটের মনিটরে তা ইন্ডিকেট করছিল। তখনই তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের জানান। ওই সময় বিমান ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ হাজার ফুট উপরে ছিল। ওই সময় বাঁ ইঞ্জিনের ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তুর্কমেনিস্তানে অবতরণের ১২ থেকে ১৫ মিনিট আগে সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, কেবল কয়েকটা নাট-বোল্ট টাইট দেয়াতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এর পর প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে উড়োজাহাজটি পুনরায় ফ্লাই করার আগে দুবার ইঞ্জিনের ট্রায়াল দেয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপর কমিটিটি করা হয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্বপন কুমার সরকারের নেতৃত্বে। এছাড়াও সিভিল এ্যাভিয়েশনের ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টর ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে বিমানমন্ত্রী বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কমিটিকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তার পরই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তদন্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন, ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হানিফ ও ইঞ্জিনিয়ার নিরঞ্জন রায়। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্যদের নাম মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি। রাশেদ খান মেনন বলেন যেটা হয়েছিল, ইঞ্জিনের ফুয়েল প্রেসার (জ্বালানির চাপ) কমে যাচ্ছিল। এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে যে, নেয়ারেস্ট (সবচেয়ে কাছের) এয়ারপোর্টে ল্যান্ড (অবতরণ) করতে হয়। সেই হিসেবে তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদে ল্যান্ড করেছিল প্লেন। সেখানেই আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা প্লেনটি সারিয়ে চার ঘণ্টা পর আবার ফ্লাই করেছে। প্রধানমন্ত্রী সেই ফ্লাইটেই রাত ১১টা ৫ মিনিটে বুদাপেস্টে পৌঁছান। রবিবার পর্যন্ত আমাদের কনসার্ন ছিল মূলত প্রধানমন্ত্রী সেফটি (নিরাপদে) পৌঁছেছেন কিনা। কেন জ্বালানির চাপ কমে গিয়েছিল এ বিষয়ে এক সাংবাদিক জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেনÑসেটা টোটালি (পুরোপুরি) টেকনিক্যাল (কারিগরি) ব্যাপার। এটা ইঞ্জিনিয়াররা বলতে পারবেন। এ ঘটনায় কারো অবহেলা দেখছেন কিনা জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন,আজকেই প্রিলিমিনারি রেসপনসিবিলিটি ডিসাইড (দায়িত্বশীলদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত) করবে তদন্ত কমিটি। তার পরই তাদের (দায়ীদের) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনেই বিমানের এক উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে ফোন দেন। মন্ত্রী ওই কর্মকর্তাকে বলেন, আপনি এখনও কাউকে সাসপেন্ড করেননি। এটা তো করতে হবে আপনাকে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী রাঙ্গা প্রভাত ফ্লাইটটিতে ওয়েল প্রেসার কমে যাবার বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে মানতে নারাজ এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের সাবেক এক প্রকৌশলী বলেছেন, আশখাবাদে জরুরী অবতরণকারী ফ্লাইটটি মেরামতের পর ক্যাপ্টেন ইসমাইল লগ বুকে যা লিখেছেন তা সত্যি হলে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগের । তিনি লিখেছেন, একটি নাট লুজ হবার মানে তো- হয় সেটা সাবোট্যাজ, না হয় গাফিলতি। ভিভিআইপি ফ্লাইট টেক অফ করার চব্বিশ ঘণ্টা আগে বুঝিয়ে দিতে হয় এসএসএফকে। তার আগেই সেটার সার্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় একাধিকবার। প্রশ্ন উঠেছে -ওটাতে যেসব প্রকৌশলী কাজ করেছে তাদের নজরে কেন সেটা ধরা পড়েনি। কিংবা প্রকৌশলীরা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে সেটা পরীক্ষা করেননি। সঠিকভাবে কাজ করলে মাত্র চার ঘণ্টা ওড়ার পর ওই নাট লুজ হবার কোন কারণ নেই। তবে সার্বিক বিচারে এটা বলা যায়, প্রকৌশল বিভাগের সীমাহীন গাফিলতি ও দৈন্যের চিত্রই ফুটে উঠেছে এ ঘটনায়। কলকাতা ফ্লাইটেও ত্রুটি ॥ আগেরদিন প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটির পর সোমবার ঢাকা -কলকাতা ফ্লাইটও দু’দফা যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে। বিমানের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ জনকণ্ঠকে জানানÑ বিজি-০৯১ ফ্লাইট সকাল সাড়ে ৮টায় ৫৫ যাত্রী নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে শাহজালাল বিমানবন্দর ছেড়ে যাবার পর পরই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এবং ক্যাপ্টেন জরুরী অবতরণে বাধ্য হন। পরে সেটা তিন ঘণ্টা ধরে মেরামত করার পর বেলা সাড়ে এগারোটায় আবারও কলকাতার উ্েদ্দশ্যে রওনা হয়। কিন্তু যশোর সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছতেই আবারও যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে। পাইলট যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা না করে সেটা নিয়ে কলকাতা না গিয়ে ফের ঢাকায় ফিরে আসেন। এর পর বেলা দেড়টায় ৭৩৭ উড়োজাহাজ দিয়ে ওই যাত্রীদের কলকাতায় পাঠানো হয়। এ ঘটনায়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। টনক নড়েছে এবার ॥ এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ার ঘটনায় টনক নড়েছে বিমান মন্ত্রণালয়ের। এবার তারা ভিভিআইপিদের জন্য একটি নতুন বিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। আগামী বছরের মধ্যেই নতুন বিমানটি কেনা হচ্ছে বলে বিমানের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিমানটি দিয়ে শুধু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দেশ-বিদেশে সফরে আনা-নেয়ার কাজ করবে। এটি দিয়ে কোন যাত্রী বহন করবে না। এ বিষয়ে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা বাংলাদেশ বিমানটি আকস্মিকভাবে অন্য একটি দেশে অবতরণ করায় বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভিভিআইপিদের জন্য আলাদা বিমান যাতে থাকে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিদেশে আনা -নেয়ার জন্য একটি উন্নতমানের বিমান কেনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আশা করি, আগামী বছরের মধ্যে বিমানটি কেনা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে সোমবার বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারাও বৈঠক করেছেন। মন্ত্রী ও সচিবসহ অন্যরা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিকেলে সংসদীয় কমিটিতেও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বৈঠকগুলোতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য আলাদা একটি বিমান কেনার বিষয়ে আলোচনা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য আলাদা বিমান রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে তা নেই। রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ সফরে যান তখন তাদের সাধারণ যাত্রীর সঙ্গে যেতে হয়। এটা অনেকটা অনিরাপদ থাকে। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, ভিভিআইপিদের জন্য একটি উন্নতমানের বিমান কিনতে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে বিমান কেনা হবে। এজন্য আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। একটি বিমান কিনতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লাগে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, রবিবারের ফ্লাইটটি আকাশে উড়াল দেয়ার আগে কতর্ৃৃপক্ষের উচিত ছিল আরও জোরালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তাহলে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটত না। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। রবিবার হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে পানি সম্মেলনে-২০১৬ অংশ নিতে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে (বোয়িং ৭৭৭ ফ্লাইট-রাঙ্গা প্রভাত) করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েক মন্ত্রী। শাহজালাল থেকে রানওয়ে ছেড়ে যাবার পর টানা চার ঘণ্টা স্বাভাবিক গতিতে চলার পর আফগানিস্তানের আকাশসীমায় পৌঁছে। হঠাৎ মধ্য আকাশে বিমানের ইঞ্জিনে ত্রুটি ধরা পড়ে। পাইলটরা দেখতে পান ককপিটে লালবাতির সঙ্কেত; যার রিডিং ছিল ইঞ্জিনে অয়েলে প্রবাহ কমে গেছে। এ অবস্থায় উড্ডয়ন ঝুঁকিপূর্ণ। তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেয়া হয় জরুরী অবতরণ করতে হবে। বাংলাদেশ সময় দুপুর আড়াইটায় তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদে নিরাপদে জরুরী অবতরণ করা হয়। এর পর বিমানটি বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই প্রকৌশলীরা যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামত করেন। এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। রাতেই বিমানের উর্ধতন কর্মকর্তারা বিশেষ বৈঠক করেন।
×