ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘের গবেষণা প্রতিবেদন

যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতি ॥ ৩৫ হাজার কোটি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতি ॥ ৩৫ হাজার কোটি

এমদাদুল হক তুহিন ॥ মিনু রহমান রাজধানীর বনশ্রী থেকে গুলশান-২ এ যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করলেন। বনশ্রী থেকে হাতিরঝিল হয়ে গুলশান-২ এ সাড়ে আট কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে প্রকৃত ভাড়া হওয়ার কথা ১২০ টাকা। অথচ যখন গুলশান ২ এ পৌঁছালেন তখন মিটারে ভাড়া উঠে ১৮০ টাকা। যানজটের কারণে ৩০ মিনিট ওয়েটিং। প্রতি মিনিটে ২ টাকা করে পরিশোধের দায়ও তাই মিনু রহমানের কাঁধেই বর্তায়। প্রতিদিন রাজধানীর মানুষ এভাবে যানজটে অর্থ গচ্চা দিচ্ছে। এর সঙ্গে রাস্তায় ব্যয় হওয়া সময়ের দাম ধরে হিসেব করলে এই ব্যয় আরও বেশি, মাত্র ৬০ টাকায় সীমাবদ্ধ নয়। ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা সরকারী ছুটির দিনেও দেয়া সম্ভব নয়। ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণের বড় উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ফ্লাইওভার ওভারপাস নির্মাণ করা হলেও খুব একটা কাজে আসেনি। কবে যানজটের হাত থেকে মুক্তি মিলবে তাই এখন বড় প্রশ্ন অনেকের কাছে। জাতিসংঘের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাাদেশে যানজটের কারণে নষ্ট হওয়া কর্মঘণ্টা, যানবাহনে পুড়ে যাওয়া বাড়তি জ¦ালানির মূল্য এবং নগরবাসীর যে স্বাস্থ্যহানি ঘটছে তার আর্থিক মূল্য বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা। ক্ষতির হিসেবে তারতাম্য থাকলেও বছরের পর বছর ধরে সঙ্কটপূর্ণ এই জনদুর্ভোগে দেশ পিছিয়ে পড়ছে। কাজে গতি আসছে না। একই দিনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ থাকলে একটির বেশি সারা যাচ্ছে না কোনক্রমেই। যানজট এড়িয়ে দৈনন্দিন যাতায়াতে নগরবাসীর এত ব্যস্ততার পরও জীবনের মূল্যবান অনেক সময় খেয়ে ফেলছে ঢাকার এই যানজট। শুধু তাই নয়, যানজটের কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে অপেক্ষা করে যথাসময়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না পারার তিক্ততা সমাজের কমবেশি সবারই আছে। এভাবে রাস্তায় আটতে থেকে বছরের পর বছর ধরে যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, সে ক্ষতি অপূরণীয়। টঙ্গী শিল্প এলাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মাহাবুব হাসান সজীব। ঢাকায় বসবাসকারী মাহবুব অধিকাংশ সময় অফিসের গাড়িতে গেলেও কখনও কখনও তাকে বাসে চড়ে যেতে হয়। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অফিসে যেতে বাসে প্রায় দেড় ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। ফেরার পথে যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করে, তখন প্রায় দুই ঘণ্টা বসে থাকতে হয় গাড়িতে। রাতেও যদি গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ থাকে কেবল যানজটের কারণে অফিস থেকে ফিরে তা আর করা সম্ভব হয় না। যানজটের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জানিয়ে সজীব বলেন, যানজটের কারণে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সারতে অন্য কারও সাহায্য নিতে হয়। যে কাজটি নিজে করলে ৫০ টাকায় সারা সম্ভব, সেই একই কাজ অন্যকে দিয়ে করাতে গেলে ২০০ টাকা পর্যন্ত দিতেও বাধ্য হই। শুধু টাকাই নয়, এক্ষেত্রে অনেক সময় কাকুতি- মিনতিও করতে হয়। এক কথায়, যানজটের কারণে আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাস খানেক আগে জরুরী কাজে দেশে এসেছিলেন প্রবাসী নাজমুল হাসান। একই দিনে দুটি কাজ পড়ে। একটি মতিঝিলের বিমান অফিসে, অন্যটি গুলশান দুই নম্বর সিটি কর্পোরেশন অফিসে। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, একই দিনে দুটি কাজ পড়ায়, একটি কাজের পুরোটি সারতে পারলেও বাকি কাজের পুরোটি সারতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, দিনের মধ্যভাগের গুরুত্বপূর্ণ দুই ঘণ্টাই আটকে ছিলাম যানজটে। আমার ওই গুরুত্বপূর্ণ সময়টি খেয়ে ফেলেছিল যানজট। বিশ্লেষকরা বলছেন, যানজট সামগ্রিকভাবে পরিবহন খরচ বাড়ায়। কোন কোন শিল্পোদ্যোক্তা যানজটের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য কার্যধারায় পরিবর্তন আনেন, এমনকি সময়সূচী এবং স্থানও পরিবর্তন করে থাকেন। যানজট নানাভাবে সাপ্লাই চেনকে প্রভাবিত করে। তারা বলছেন, যানজট গতি কমিয়ে দেয়, অযাচিত বিলম্ব ঘটায়, ট্রাফিক প্যাটার্ন পরিবর্তন করতে বাধ্য করে, যার সব উপাদানই কোন না কোনভাবে বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে। শুধু বাংলাদেশে নয়, যানজটে মোটা অঙ্কের ক্ষতি হয় যুক্তরাষ্ট্রেরও। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের টরেন্টো ও হ্যামিলটনে যানজটে বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার। সে দেশে ২০৩০ সালে এ খরচ ৭২০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উন্নততর পরিবহন প্রযুুুক্তির বিকাশ ও প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এবং একটি জাতীয় অভ্যন্তরীণ ট্রাফিক সিস্টেম প্রণয়ন করে যানজট সমস্যা দূর করা সম্ভব। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যানজটের প্রধান কারণ ১৯টি। গবেষকরা বলছেন, রাজধানীতে ৩০ ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলছে। সোয়া দুই লাখের স্থলে সাড়ে নয় লাখ গাড়ি চলাচলের অনুমোদন কোন অবস্থাতেই সুখকর নয়। উল্টো পথে চলা ও আইন না মানা, কার পার্কিংয়ের স্থানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল (অর্থাৎ আটভাগ সড়কের মধ্যে কার্যকর রাস্তা মাত্র আড়াই ভাগ) সিএনজি স্টেশন, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকা, ট্রাফিক সদস্যদের প্রশিক্ষণের অভাবেই যানজট হচ্ছে। পাশপাশি উন্নয়ন কাজ সময়মতো না হওয়াকেও যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে দিনে ৩১৭টি নতুন গাড়ির অনুমোদন দেয়া ঠিক নয়। তাছাড়া অবৈধ পার্কিং বন্ধ, ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করলেই ৩০ ভাগ যানজট কমে আসবে। নগরীতে হেঁটে চলাচল করেন ৬০ ভাগ মানুষ। রিক্সায় ১৯ ভাগ। বাস ও অটোরিক্সায় ১৬ ভাগ, প্রাইভেটকারে মাত্র ৫ ভাগ মানুষ যাতায়াত করেন অথচ প্রাইভেট কারের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বেশি। তবে যানজট নিরসনে কোন পদক্ষেপই কাজে আসছে না। যানজটের কারণে সামাজিকভাবেও ক্ষতি হচ্ছে মানুষের। গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে সন্ধ্যা ৬টায় যে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল তা শুরু হতে হতে ঘড়ির কাঁটায় তখন ৭টা। বহুজাতিক ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু হওয়ার কারণ হিসেবে জানানো হয়, ঢাকার যানজট। যথাসময়ে যারা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন তারা যেমন বিরক্ত হয়েছেন, তেমনি বিব্রত হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও। নগরীতে প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। যথাসময়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপস্থিত হতে না পারায় ওই ব্যক্তির প্রতি অন্যদের তৈরি হয় অনাস্থা। এভাবে মানসকি অস্থিরতা তৈরিসহ সামাজিক অনাস্থা তৈরিতেও যানজট নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। যানজটের কারণে দেশে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে দৈনিক ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যানজটে আটকা পড়ে অপচয় হওয়া কর্মঘণ্টা, ওই সময়ে যানবাহনের পুড়ে যাওয়া বাড়তি জ¦ালানির মূল্য এবং তাতে নগরবাসীর যে স্বাস্থ্যহানি ঘটছে এর আর্থিক মূল্য বছরে ৪৬০ কোটি ডলার বা ৩৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ইউএনডিপির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানীর বেশিরভাগ নাগরিকই মনে করেন প্রয়োজনের তুলনায় এখানে গণপরিবহনের সংখ্যা অনেক কম। বিকল্প কোন উপায় না থাকায় অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি ও তিন চাকার গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা। এতে বলা হয়, যানজটের কারণে দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর বেসকারী গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে বছর প্রতি ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, যানজটের কারণে দেশের মোটা অঙ্কের ক্ষতি হচ্ছে। হিসাবে তারতাম্য থাকলেও বিশাল অঙ্কের ক্ষতি হচ্ছে, এ কথা অনস্বীকার্য। সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকছে, এতে তার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের অপচয় হচ্ছে। যানজটের কারণে বাসে ৩ গুণ তেল পোড়ে। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাবে শহরে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। যানজট নিরসনে সরকারের পক্ষে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হলেও এসব পদক্ষেপ কোন কাজেই আসছে না। নগরবাসীও যানজটে নাকাল এই অবস্থা থেকে পাচ্ছে না পরিত্রাণ। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে আইন মেনে চলার কথা বলা হলেও এক শ্রেণীর মানুষ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে তাদের। কোন রকম আইনের তোয়াক্কা না করে ফুটপাথ দিয়ে যেমন চলে হোন্ডা, তেমনি লাইসেন্স ছাড়াও গাড়ি নামে পথে। আবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ফুটপাথে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হলেও সে উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে বার বার।
×