ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেনা অভিযানে নিহত ১৩০

সুচির বিরোধিতা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা উৎখাতে অনড়

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

সুচির বিরোধিতা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা উৎখাতে অনড়

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সেনা অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে ১৩০ রোহিঙ্গা নরনারী। যদিও সরকারীভাবে এ সংখ্যা এখনও ৬৯ বলে বলা হচ্ছে। বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও এনজিও কর্মীদের তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের ৫টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত প্রদেশের মধ্যে রাখাইনদের অবস্থা অমানবিক। ঘরে ঘরে অভিযান, জ্বালাও-পোড়াও, খুন, হত্যা, ধর্ষণ লেগেই আছে। জানা গেছে, গণতন্ত্রীমনা অং সান সুচির সরকারের সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা সম্প্রদায় নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উৎখাতে অনড় রয়েছে। সে দেশের সরকারী হিসাবে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ৮ লাখের সামান্য বেশি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী হয়ে এসে এবং পাশাপাশি অবৈধ পথে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বসতি গেঁড়ে গত কয়েক দশকে এদের সংখ্যা এখন ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সেখানকার বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়েই সেনা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এদিকে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী নাফ নদীতে রাতের বেলায় মাছ শিকার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে দিনের বেলায় মাছ শিকারে কোন নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সেনা বর্বরতা চলছে সে ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মিডিয়া কর্মীদের প্রবেশাধিকার মোটেই নেই, এমনকি এনজিও বা সাহায্য সংস্থার কর্মীরাও সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য কয়েকটি এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়া হলেও মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এছাড়া ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া বিদেশীদেরও গ্রেফতার অভিযান চলছে। ‘মাবাতা’ নামে ধর্মীয় উগ্রপন্থী সংস্থাটির প্রত্যক্ষ ইন্ধনে রোহিঙ্গা মুসলমান নিধনের যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে তাতে সে দেশের মানবতাবাদী সংগঠনগুলোও এক ধরনের নীরব ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশসমূহের সকল আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখে বিশ্বজুড়ে যে বর্বরতার কালো অধ্যায় রচনা করেছে তা ইতিহাসে বিরল। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসাবে বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত। ওরা নিজ দেশে পরবাসী। সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত। নাগরিকত্ব নেই। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতে প্রয়োজন হয় অনুমতির। এভাবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কেবলই কমছে। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশেই বেশি। অপরদিকে মিয়ানমারে সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা করে চলছে বিজিবি। বুধ ও বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ওসব সভায় রাতের বেলায় নাফনদীতে মাছ শিকার না করে দিনের বেলায় মাছ শিকারের জন্য জেলেদের উৎসাহিত করা হয়েছে। নাফনদীতে মাছ আহরণের সময় শূন্য রেখা অতিক্রম না করার তাগিদ দিয়ে বিজিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এতে দেশীয় জলসীমায় বিজিবির অবস্থানের সময় নদীতে মাছ শিকারকালে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা হলে তা বিজিবি সদস্যদের জবাবদিহি করতে হবে। কোন প্রকার অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনা পরিলক্ষিত হলে তা বিজিবিকে অবগত করার জন্য জেলেদের অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা যাতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারেও সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিজিবি। টেকনাফ ২ বর্ডার গার্ড ব্যাটলিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ আবু জার আল জাহিদ জানান, বুধবার টেকনাফে সীমান্ত চৌকি হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, ঝিমংখালী, খারাংখালী, হ্নীলা, লেদা, নোয়াপাড়া, দমদমিয়া, টেকনাফ সদর, নাজির পাড়া, সাবরাং ও শাহপরীরদ্বীপ দায়িত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে মিয়ানমারে চলমান উদ্ভূত সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সীমান্তে বসবাসরত নাগরিকদের নাফনদীতে মাছ ধরা ও চলাচলে সীমাবদ্ধতা বজায় রাখতে স্ব স্ব এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, সাধারণ জনগণ ও জেলেরা উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময়ের পাশাপাশি সীমান্ত রক্ষা ও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অতিরিক্ত তিন প্লার্টুন বিজিবি সদস্য পাঠানো হয়েছে বলে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে। এদিকে মিয়ানমারের মংডু ও বলিবাজার এলাকায় দেশটির সেনা বাহিনীর হত্যা যজ্ঞের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে শত শত রোহিঙ্গা ভিড় করছে প্রতিনিয়ত। আরাকানে সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া ছেদ করে ওসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করলেও বাধা দিচ্ছে না দেশটির সীমান্তরক্ষী দল (বিজিপি)। বিজিপি সদস্যরা ওই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে চলছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সে দেশ থেকে সমূলে বিনাশ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত বলে এপার ও ওপারের বিভিন্ন সূত্রে মত প্রকাশ করা হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে ১০ অক্টোবর থেকে সেনা অভিযানে এ পর্যন্ত সেনা অভিযানে ১৩০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নরনারী প্রাণ হারানোর ঘটনা ছাড়াও ৪টি পাড়া ও তিন শতাধিক ঘরবাড়ি জালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে সে দেশের সেনাবাহিনীর দাবি অনুযায়ী বিজিপি চৌকিতে হামলার পর থেকে এক কমান্ডিং অফিসারসহ ৭ সেনা সদস্য এবং ১০ পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনার পর প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গাকে সে দেশের সেনা সদস্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। এরা আদৌ বেঁচে আছে না মেরে ফেলা হয়েছে তা এখনও অজানা। সর্বশেষ বুধবার সকালে প্রাণ নিয়ে অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা ২ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরাকানের মংডু জেলায় বেপরোয়া হারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। ফলে প্রাণ ভয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা মংডু, কাউয়ারবিল, নাকপুরা ও ঘুনচিপাড়া বিজিপি ক্যাম্পে হামলা ঘটনায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে আরএসও জড়িত রয়েছে মর্মে দেশটির কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতির ওপর ঢালাওভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বিজিপি-সেনা সদস্যরা। এতে রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ সপরিবারে বাংলাদেশমুখী হয়েছে। টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা ক্ষোভের সঙ্গে বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, কিছুসংখ্যক আরএসও সদস্যের জন্য গোটা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ দল যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা নজিরবিহীন। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী বাধ্য করছে রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগে।
×