ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আনসারুল্লাহর আধ্যাত্মিক গুরুর বিরুদ্ধে মামলা আলোর মুখ দেখছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৯ নভেম্বর ২০১৬

আনসারুল্লাহর আধ্যাত্মিক গুরুর বিরুদ্ধে মামলা আলোর মুখ দেখছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দীর্ঘ দুই বছর পর নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীসহ দশজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে ঢাকা মহানগর জজ আদালত। এরই মধ্য দিয়ে মামলাটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়েছে। মামলার অভিযোগ গঠনের জন্য শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে ঢাকা মহানগর জজ আদালত। মঙ্গলবার পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্র আমলে নেন ঢাকা মহানগর জজ কামরুল হোসেন মোল্লা। তিনি আগামী ২৭ নবেম্বর অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আদালতের এমন আদেশের ফলে প্রায় দুই বছর ধরে অনুমোদন জটিলতায় পড়ে থাকা মামলাটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। আসামিরা হলো- ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় পাঁচ বছরের কারাদ- হওয়া জসীমুদ্দিন রাহমানী, সাইফুল ইসলাম ওরফে প্রিন্স ওরফে বাবু ওরফে নাঈম, মোঃ আবু হানিফ, মোঃ জাহিদুর রহমান, কাজী রেজোয়ান, কাজী নাইমুল হাসান, জুন্নুন, আমিনুল ইসলাম, আলী আজাদ ও আব্দুল্লাহ আল আসাদুল্লাহ ওরফে পিয়াস। উগ্রপন্থী খুতবা ও বয়ান প্রচারের মাধ্যমে জঙ্গী তৎপরতায় প্ররোচিত করার অভিযোগে ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি দায়ের করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ (বর্তমানে বদলিকৃত)। পরের বছরের ৮ সেপ্টেম্বর পরিদর্শক আব্দুল লতিফ শেখ আদালতে দশ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। সেখানে বলা হয়, আসামিরা দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার ষড়যন্ত্র এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলার বিচার করতে গেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় মামলার কার্যক্রম আটকে যায় বলে এ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলি তাপস কুমার পাল জানান। সেই অনুমোদন মেলার পর মঙ্গলবার আদালত অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে মামলার কার্যক্রম আবার শুরু করে। তাপস জানান, মামলার প্রধান আসামি রাহমানীর সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের কথা এসেছে অভিযোগপত্রে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাহমানী আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ধানম-ি, দিলকুশা, মতিঝিল, মিরপুর, নর্থসাউথ রোড, বরিশাল ও কুমিল্লার বিভিন্ন শাখায় দুই কোটি ৪৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা জমা ও উত্তোলন করেছেন। এর মধ্যে বরিশালের এ্যাকাউন্টে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে চাকরিজীবী। অন্যান্য শাখায় ইমাম। ওই অর্থ জঙ্গী তৎপরতায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসামিদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম ওরফে প্রিন্স, আবু হানিফ ও জাহিদুর রহমানকে মঙ্গলবার কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। বাকি আসামিদের মধ্যে আজাদ জামিনে এবং বাকিরা পলাতক। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে (ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়। এমন রায়ের সূত্র ধরেই সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ব্লগার ছিলেন প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন (৩৭)। তিনি থাবা বাবা নামে একটি ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি করতেন। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে পরিকল্পিতভাবে রাজধানীর পল্লবী থানার পলাশনগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজ বাড়ির সামনেই রাজীবকে জবাই করে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। শাহবাগে রাজীবের জানাজা আদায়কারী ইমামকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়। রাজীবের লাশ ঢাকা চিড়িয়াখানার বাঘের খাবার হিসেবে দেয়া হোক বলে অনলাইনে মন্তব্য করে শফিউর রহমান ফারাবী নামের একজন। অবশেষে ছাত্রশিবিরের সাবেক কর্মী ফারাবী গ্রেফতার হয়। তার দেয়া তথ্য মোতাবেকই ২০১৩ সালের ১ মার্চ রাজীব হত্যার দায়ে রাজধানীর বনানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), এহসান রেজা ওরফে রুম্মন (২৩), নাইম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ (২২) গ্রেফতার হয় ডিবি পুলিশের হাতে। তারা রাজীব হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। ইমানী দায়িত্ব পালন করতেই তারা রাজীবকে হত্যা করে বলে আদালতে স্বীকার করে। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের একটি সংগঠনের সদস্য বলে জানায়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এরপর বেরিয়ে আসে সংগঠনটির নানা তৎপরতার কাহিনী। ২০০৯ সাল থেকে সংগঠনটি তৎপর। সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানী। রাহমানী ধানম-ির হাতিমবাগ মসজিদের ইমাম ছিলেন। তার বয়ান জুমার খুতবা নামে প্রচার চালানো হতো। তার বয়ানে উগ্র মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। পরবর্তীতে রাহমানীসহ দশজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সংগঠনটির প্রধান টার্গেট বাংলাদেশে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা। এজন্য তারা আল কায়েদার অনুরূপ আদর্শ, নীতি এবং কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে। সে লক্ষ্যে তারা চার থেকে পাঁচজন করে ছোট ছোট গেরিলা টিম গঠন করে। পাকিস্তানে নিহত জেএমবির কারাবন্দী আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের স্বামী ইজাজ হোসেন ওরফে কারগিল সংগঠনটি পরিচালনার জন্য নানাভাবে সহযোগিতা করত। ইজাজ ২০০৮ সালে সামরিক প্রশিক্ষণ ও জঙ্গী কার্যক্রমে দীক্ষিত হওয়ার জন্য পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল। সে জামায়াতুল মুসলিমিনের বাংলাদেশের আমির ছিল। জামায়াতুল মুসলিমিনের আন্তর্জাতিক আমির জর্দান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শেখ আবু ইসা আলী আররিফাই আল হাশেমী আল কোরাইশি-ই-আবু ইসা। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঢাকার বারিধারার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া করে তিনি সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। পরে তিনি ব্রিটেনে ফিরে গেলে জঙ্গীবাদের দায়ে গ্রেফতার হন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম দাওয়াতী কার্যক্রমের পাশাপাশি গুপ্তহত্যা চালাত। তারই ধারাবাহিকতায় সংগঠনটির একটি সিøপার সেল ব্লগার রাজীবকে হত্যা করে। রাহমানীর মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০০৮ সালে তেহজীব, রেজওয়ান শরীফ ও মইনউদ্দিন ইয়েমেনে গমন করে। তারা আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ঘনিষ্ঠ সহযোগী সামির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ২০০৯ সালে রেজোয়ান শরিফ ইয়েমেনে গ্রেফতার হয়। রাজীব শরীফ ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাকালে গ্রেফতার হয়। তার ২০ বছরের কারাদ- হয়েছে। নাফিস যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়ে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও তেহরিক-ই-তালেবানের অনুসারী। হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর সংগঠনটির নেতাকর্মীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের সংগঠনের ব্যানারে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত থাকার দায়ে সরকার বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
×