ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছাতিম তরু

অসাধারণ সুন্দর- হেমন্ত হাওয়ায় ম-ম গন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১ নভেম্বর ২০১৬

অসাধারণ সুন্দর- হেমন্ত হাওয়ায় ম-ম গন্ধ

সমুদ্র হক ॥ প্রায় দুর্লভ হয়ে পড়েছে অসাধারণ সুন্দর গাছটি। তারপরও হঠাৎ দেখা মিলল। মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। এ সময়টায় শিশির পড়ছে। প্রায় নির্জন পথ। বগুড়া শহরের সার্কিট হাউসের সামনের নওয়াব বাড়ি সড়কটি কিছুটা অন্যরকম। নিশুতি রাতে ছিমছাম। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতায় গাছের পাতাগুলো চিকচিক করছে। এর মধ্যেই প্রহর গোনা পাখি পেঁচার ডাক শোনা গেল। মনে হচ্ছিল স্বপ্নের ঘোর। হঠাৎ নাকে ঝাপটা দিয়ে গেল ম ম গন্ধে মাখা হেমন্তের হাওয়া। এক মধুময় সৌরভ। মোটেও উপেক্ষা করা গেল না। ইতি উতি তাকাতেই সড়কের ধারে সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (ভিএম স্কুল) ভেতরের এক কোনায় চোখে পড়ল ঝাঁকড়া পাতা পল্লব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ লম্বা এক গাছ। ছাতিম। অনেক দিনের পুরনো। ১৮৬৯ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আছে। গুঁড়িতে বাকলগুলো কুন্দের মতো ফুলে আছে। তাতে বৃদ্ধের মুখের বলিরেখার মতো অজস্র সরু স্ফীত রেখায় ভরা। ওপরে গুচ্ছ গুচ্ছ পাতা। কেবলই ফোটা ফুলের থোকায় কী মায়াময়তা। নীরবে দাঁড়িয়ে সৌরভের মিতালি করছে রাতের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় সঙ্গে। এই বাতাস যেন মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছে পাতায় পাতায়। ছাতিম তরুর সঙ্গে ছাতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কা- কিছুটা লম্বা হয়ে শাখা প্রশাখায় পাতার বিস্তারে মেলে ধরে। কা-ের কয়েক ধাপে পুরো গাছ গাঢ় সবুজ পাতায় সাজানো। এই পাতা থাকে ভর বছর। তাই সারা বছর ছায়াময়ও থাকে ছাতিমতলা। ঘন ছায়ার জন্য সাধু সন্ন্যাসী ও মুনি ঋষিরা ধ্যানে বসত ছাতিম তরুতলে। পাতার ধরন বর্ষার ফলকের মতো। কা-ের গ্রন্থিতে সাধারণত সাতটি পাতা বৃত্তাকার হয়ে থাকে। যে কারণে সংস্কৃতিতে এর নাম ‘সপ্তপর্ণী’। তবে আরও নাম খুঁজে পাওয়া যায়। ড. নওয়াজেশ আহমেদ তার বাংলা বনফুল গ্রন্থে ছাতিমের অনেক নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন সুপর্নক, পত্রবর্ণ, শুক্তিপর্ণ, গন্ধিপর্ণ, গুচ্ছপুষ্প, শারদী বিনক ইত্যাদি। ছাতিম তরুর বড় একটি তথ্য আছে শান্তি নিকেতনে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সমাবর্তনের সময় প্রথম উপহার দিতেন ছাতিম পাতা। বর্তমানে যারা মধ্য বয়সী তারা ছাতিমের সঙ্গ পেয়েছেন একটু ভিন্নভাবে। খুবই নিকট অতীতে স্কুল কলেজের শ্রেণী কক্ষে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর সাদা চক পেন্সিলে লেখা হতো। (বর্তমানে প্লাস্টিক সিটের বোর্ডে মার্কার পেনে লেখা হয়)। সেদিনের সেই ব্ল্যাকবোর্ড তৈরি হতো ছাতিম কাঠ দিয়ে। ছাতিমের কাঠ হালকা ও মসৃণ, যা ব্ল্যাকবোর্ড তৈরির জন্য উপযুক্ত। কাঠ পেন্সিল তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় ছাতিম কাঠ। ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম এ্যাল্সটোনিয়া স্কলার। তবে ছাতিম গাছের ইংরেজী নাম একটু বিদ্ঘুঁটে ‘ডেভিল ট্রি’। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ভুতের গাছ। যদিও ভুতপ্রেত কুসংস্কার তারপরও অতীতে গভীর রাতে এই গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছমছম ভাব চলে আসত। এই গাছকে নিয়ে লোক ছড়া আছে ‘শ্যাওড়া গাছে পেতনী ঠাঁসা, ছাতিম গাছে ভুতের বাসা’। প্রযুক্তির এই যুগে ভুত-প্রেত কবে পালিয়েছে। দুর্লভ এই গাছকে রক্ষা করবার এখন আর কোন উদ্যোগ নেই। বর্ষাকালে বৃক্ষ রোপণের মৌসুমে অনেক গাছের চারাই রোপিত হয়। সেখানে থাকে না শুধু ছাতিমতরুর চারা বা বীজ। একটা সময় দেশে অনেক ছাতিমতরু ছিল, যা মূলত প্রকৃতির ছাতা। ছাতিম কাঠের বাণিজ্যিক মূল্য না থাকায় ‘বাণিজ্যিক যুগে’ এই গাছ কেউ রোপণ করে না। উল্টো ছাতিম গাছ কেটে ফেলে। কে আর সৌন্দর্য ও মধুগন্ধে এই তরু রোপণ করে। এখন কালে ভদ্রে চোখে পড়ে ছাতিমতরু। যা আছে তাও কর্তনের খাতায় উঠছে। কতদিন আর রক্ষা করা যাবে এই ছাতিম তরু। বর্তমান প্রজন্ম ছাতিমতরু ঠিকমতো চেনেই না। ছাতিমের ফুল ফোটা শুরু হয় শরতের শেষে। প্রস্ফুটনের মৌসুম হেমন্ত। শীতের মধ্যভাগ পর্যন্ত থোকায় থোকায় ফোটে এই ফুল। একটা সময় মনে হবে গাছের সকল শাখা প্রশাখা পাতা লুকিয়ে ফুলে ফুলে ভরে গেছে। ছাতিমের ফুলও সবুজাভ। ফুলের নিচের অংশ নলের মতো। ওপরের অংশে পাঁচটি পাঁপড়ি সামান্য বাঁকানো। পরাগকেশ ও গর্ভকেশ পরস্পর সংযুক্ত। ফলে তীব্র মধুগন্ধ হাওয়ায় ভেসে যায় দূর বহুদূর....। ছাতিমের ফল অনেকটা লম্বা। শীতের শেষে ফলগুলো গাছের আরেক শোভা এনে দেয়। এর বীজ রোমশ সহজেই চারা গজিয়ে ওঠে। ছাতিমের রয়েছে অসাধারণ ভেষজ গুণ। এর ছাল ও আঠা জ্বর, হাঁপানি, ক্ষত, আমাশয় ও কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহৃত। ছাতিম তরুর আদি নিবাস বাংলাদেশসহ ভারত, চীন, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা। শরত শেষে হেমন্তের শুরুতে রাতে ছাতিম গাছের আশপাশে দিয়ে যাওয়ার সময় জানান দেয় অস্তিত্ব। ছাতিম তরুতলের ফুলের গন্ধ আজও মনে করিয়ে দেয় সেদিনের ছাতিম তলার কতো কথা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছাতিম তরু আছে। যে সংখ্যা খুবই কম। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর কয়েকটি স্থানে ছাতিম তরুর সন্ধান মেলে। নিমতলী, নিউ ইস্কাটন রোড, পুরনো পাসপোর্ট অফিসের প্রাঙ্গণে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একটি গাছ। আরও হয়ত কোথাও আছে বিচ্ছিন্নভাবে। এখন আর কে খোঁজ রাখে এসবের। যে ছাতিম তরু এখনও ফুলের ম ম গন্ধে প্রকৃতিতে তার অস্তিত্ব জানান দেয়, অদূর ভবিষ্যতে আর কতদিন তা দিতে পারবে! মুনি ঋষিরা ধ্যানে বসে জপতপের জন্য ছাতিম তরু খুঁজে পাবে তো...।
×