ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কণ্ঠে তার দারিদ্র্য জয়ের উচ্ছ্বাস

কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রশিক্ষণ পাল্টে দিয়েছে কামরুনের জীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রশিক্ষণ  পাল্টে দিয়েছে  কামরুনের জীবন

আনোয়ার রোজেন ॥ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা আওয়াজ শুনে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। আত্মনির্ভরশীল কামরুন নেসার (২৬) কণ্ঠে দারিদ্র্য জয়ের উচ্ছ্বাস। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার অভাবী কামরুনের সংসারে আজ সচ্ছলতা এসেছে। এখন তিনি তিনটি কাপড় সেলাইয়ের মেশিনের মালিক। অথচ একটা সময় ঈদের দিনও পুরনো কাপড় সেলাই করে পরতে হয়েছে! ‘কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদারকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প কামরুনের জীবন পাল্টে দিয়েছে। প্রকল্পটি কামরুন নেসার মতো গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণ, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। প্রকল্পের আওতায় নেয়া ঋণের মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার বেকার যুব নারী-পুরুষ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নেমেছে। নারীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নারী উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন ধরনের ‘কোর্স’-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছে তরুণ ও যুবকরা। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণ অঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ এবং প্রসবকালীন মৃত্যুর হারও আনুপাতিক হারে কমে আসছে। সম্প্রতি প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়ে চলছে, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট সমাজে স্বচ্ছলতা ফিরে আসছে যা সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করছে। নারীর উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতার হার কমানো ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ‘কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদারকরণ (সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পটি দেশের ৫৭ জেলার ৪৪২ উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদফতর। মোট ১০৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্পটির মেয়াদ জানুয়ারি ২০১২ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত। প্রকল্পটি থেকে সুফল পাওয়ার পাশাপাশি এর বিভিন্ন দুর্বলতাও তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি হতে সঠিক সুফল পেতে বিভিন্ন সুপারিশও করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও যুব উন্নয়ন অধিদফতরের উপ-সচিব এএইচএম সামসুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৯ লাখ ৭২ হাজার প্রান্তিক মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রায় ৭ লাখ ১৭ হাজার জন, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭৩ শতাংশ পূরণ করেছে। শুধু তাই নয়, বাছাই করা ৬ হাজার ৭০০ প্রশিক্ষণার্থীদের কর্মসংস্থানে সহায়তার জন্য ১৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হবে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ২০ জন নারী-পুরুষের প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেয়া গেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব নিরসনে প্রকল্পটি কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। তবে প্রকল্পে প্রশিক্ষণ ব্যয়ের চেয়ে ঋণের পরিমাণ অনেক কম। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষণ উপকরণ ও সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষকের কারিগরি অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে বরাদ্দ বাড়ালে আরও সুফল মিলতে পারে। জানা গেছে, প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো- স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে হাতেকলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকার যুবাদের দক্ষ ও আধা-দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা। প্রশিক্ষিত যুবাদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক কার্যক্রমে নিয়োজিত করে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কমানো। প্রকল্পটির মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে চাহিদার ভিত্তিতে তরুণ-যুবকদের বিভিন্ন ‘টেড্র কোর্স’-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এগুলো হলো, ব্লক-বাটিক ও প্রিন্টিং, মাছের খাদ্য তৈরি, পোল্ট্রি পালন, গাভী পালন, বিউটি পার্লার, মোবাইল ফোন মেরামত, গরু মোটাতাজাকরণ, মাছের খাদ্য উৎপাদন, শুঁটকি মাছ উৎপাদন, নার্সারি, দর্জি, নকশীকাঁথা, বাঁশ ও বেতের কাজ, ফুল চাষ, ছাগল পালন, এমব্রয়ডারি/সেলাই কাজ, শাক-সবজি চাষ, মাশরুম চাষ, তাঁত বুনন, মোটরসাইকেল মেরামত, মোমবাতি তৈরি, বেসিক কম্পিউটার কোর্স, গবাদি পশুপালন, রান্না শিক্ষা ও কুটির শিল্প। আইএমইডির প্রতিবেদনে উপকারভোগীদের তথ্য নিয়ে জরিপ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, যে সকল প্রশিক্ষণার্থী নার্সারিতে কাজ করছেন তাদের আয় সর্বাধিক ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা বুটিক ও প্রিন্টিং কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৫০ ভাগ, মাছের খাবার তৈরিতে আত্মকর্মীর আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪ দশমিক ১০ শতাংশ। হাঁস-মুরগি ও পোল্ট্রি পালনে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩২ শতাংশ, গাভী পালনে ৩৫ শতাংশ, মোবাইল ফোন মেরামতকারীর আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২ শতাংশ, গরু মোটাতাজাকরণের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮ শতাংশ, পোশাক তৈরি ও অন্যান্য কাজে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৪০ শতাংশ ও ৫২ শতাংশ। এছাড়া জরিপে অংশ নেয়া ৫০ শতাংশ প্রশিক্ষক জানিয়েছেন যে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ভোক্তা ও গ্রাহকদের সঙ্গে উৎপাদনকারীদের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে। এছাড়া প্রশিক্ষকদের মধ্য থেকে ২৯ দশমিক ২ শতাংশ বলেছেন, বাল্যবিবাহ কমেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করার কথা বলেছেন ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। জরিপ অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় বেকারত্বের হার কমেছে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। জরিপে অংশ নেয়া ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছেন এই প্রশিক্ষণ তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে, ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে এবং ৪ দশমিক ২ শতাংশ বলেছেন মানুষের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটির কিছু দুর্বলতাও জরিপে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রেড অনুসারে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অভাব রয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত ভাতা না পাওয়া, প্রশিক্ষণ শেষে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ না পাওয়াও দুর্বলতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য সুপারিশে বলা হয়েছে, ঋণ প্রদান নীতিমালা শিথিল করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণার্থীদের আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুব উন্নয়ন অধিদফতর যে ঋণ দেয় তার নীতিমালা অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো। তাই প্রশিক্ষণার্থীদের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ঋণ প্রদানের নীতিমালা শিথিল করা প্রয়োজন। আবার প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত যুবাদের ক্ষুদ্র উদ্যোগ পরিচালনায় যথাযথ দিক-নির্দেশনার অভাব রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়েও প্রশিক্ষণকালে সঠিক নির্দেশনা দেয়া হয় না। এতে প্রশিক্ষণার্থীদের নেয়া সম্ভাবনাময় উদ্যোগগুলো মার খায়। তারা আত্মনির্ভর হতে ব্যর্থ হয়। এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
×