ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন একাডেমিক কাউন্সিল অনুমোদন দিলেই সিদ্ধান্ত

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় আপত্তি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় আপত্তি

বিভাষ বাড়ৈ ॥ অনিয়ম বন্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার সঙ্গে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণে সরকারের দেয়া নির্দেশনা শীঘ্রই গ্রহণ করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর স্ব-স্ব একাডেমিক কাউন্সিল বিষয়টিতে অনুমোদন দিলে তবেই তা গ্রহণ করা হবে বলে বলছেন উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপাচার্যরা দাবি করছেন নিয়োগ এমনিতেই স্বচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে। তবে শিক্ষকরা অনেকেই বলছেন, নানা অনিয়মের প্রেক্ষাপটে নিয়োগ পরীক্ষা অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য জরুরী। রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকা-ে জড়িতদের নিয়োগ বন্ধে পুলিশ ভেরিফিকেশনকে সমর্থন করেছেন শিক্ষকরা। তবে লিখিত পরীক্ষা নিলেই স্বচ্ছ হয় না, দেখতে হবে সে পড়াতে পারে কিনা -এমন মন্তব্য করে অনেকে আবার আদেশকে অদ্ভুত ও অগ্রহণযোগ্য বলে আপত্তি তুলেছেন। এর আগে বুধবার সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও সুপারিশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগের আদেশ জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আদেশে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত অপরাধীদের নিয়োগ বন্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে লিখিত পরীক্ষা নেয়ার আদেশ দিয়ে বলা হয়, শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলে প্রার্থীর মেধা যাচাই করা সহজ হবে এবং অনিয়মের সুযোগ হ্রাস পাবে। জানা গেছে, সরকারী সকল নিয়োগের আগে প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন করার বিধান থাকলেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে তা করা হয় না। যেখানে নিয়োগে নেই কোন লিখিত পরীক্ষাও। এমন অবস্থায় ফাঁক ফোঁকর দিয়ে নানা উপায়ে সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকা-ে জড়িত উগ্রবাদী ব্যক্তি নিয়োগ পেয়ে যায় বলে সম্প্রতি সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নও করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এমনই এক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত অপরাধীদের প্রবেশ বন্ধ ও নিয়োগে অনিয়ম কমাতে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি নির্দেশনা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে পাওয়া গোপনীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ (ইউজিসি) সংশ্লিষ্টদের এসব নির্দেশনা দিয়েছে। ইউজিসি সচিবকে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ইদানিং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অনভিপ্রেত অবস্থার সমাধানকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাওয়া গোয়েন্দা বিভাগের গোপনীয় প্রতিবেদনে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার লক্ষ্যে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় এতে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলে প্রার্থীর মেধা যাচাই করা সহজ হবে এবং অনিয়মের সুযোগ হ্রাস পাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এসব নির্দেশনা অনুসরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে ইউজিসিকে অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে উদ্বিগ্ন মঞ্জুরি কমিশন। নিয়োগে সরকারের অবস্থানের কারণ সম্পর্কে আরও জানা গেছে, অনুমোদন ছাড়াই ৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েকটি বিভাগ খোলার চেষ্টা করার অভিযোগ পাওয়ার পর সম্প্রতি ইউজিসি তা নাকচ করে দিয়েছে। এই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়কে হুঁশিয়ারি দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে ইউজিসি। গণবিজ্ঞপ্তিতে ইউজিসি বলেছে, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি’র পূর্বানুমোদন না নিয়ে নতুন অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউট, সেন্টার বা কোর্স খোলা ও জনবল নিয়োগ এবং শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। কিন্তু ইউজিসি’র পূর্বানুমোদন না নিয়ে এটা করা যাবে না। কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয় যদি এমন অনিয়ম করে বিভাগ খোলে এবং ওই বিভাগ থেকে যেসব শিক্ষার্থী পাস করে বের হবেন, তাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই। এছাড়া ওই খাতে ইউজিসি কোন অর্থও ছাড় দেবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েও কর্তৃপক্ষের গোঁড়ামিতে নারী শিক্ষক নিলোপল আদ্রি যোগদান করতে পারেননি। আদালতের আদেশের পরও তার নিয়োগ নিয়ে চলে টালবাহানা। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে পুরো বুয়েট। তবে নানা অনিয়মের প্রেক্ষাপটে সরকারী আদেশ জারি হলে তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ লিখিত পরীক্ষার পক্ষে মত দিলেও শিক্ষকরা অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়ায় নিয়োগ পরীক্ষার আদেশের জন্য সমালোচনা করেছেন আমলা ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের। লিখিত পরীক্ষা নিলেই স্বচ্ছ হয় না, দেখতে হবে সে পড়াতে পারে কিনা- এমন মন্তব্য করে শিক্ষকরা অনেকে বলেছেন, যেসব দেশকে আমরা উচ্চশিক্ষার তীর্থস্থান বলে মনে করি, সেখানে কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা নেয়ার বিধান নেই। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। চিঠি পেয়ে নেই, তারপর বলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এটি একটি পরামর্শ ও নির্দেশনা। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যারা দূরদূরান্ত থেকে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করে কিংবা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করলে তাদের পরিচয় শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এটি জরুরী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেয়া হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, তারা এখনও আদেশের কপি হাতে পাননি। তবে আদেশের কপি পেলেই হবে না। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর একাডেমিক কাউন্সিল বিষয়টিতে অনুমোদন দিলে তবেই তা গ্রহণ করা যাবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। তিনি বলেন, আসলে বুয়েটের নিয়োগ অত্যন্ত স্বচ্ছ। এখানে নতুন কিছু করার কোন প্রয়োজন নেই। তার পরেও যদি সরকার আদেশ দেয় তাহলে তা একাডেমিক কাউন্সিল বৈঠক করে দেখবে। একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন লাগবে এসব বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে। আগে আদেশের কপি পাই। তার পরে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হবে। লিখিত পরীক্ষা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী ফেসবুকে লেখেন, ‘আমলা এবং গোয়েন্দা বন্ধুদের জন্য অত্যন্ত অনভিপ্রেত শুনালেও বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের গোয়েন্দা এবং আমলাদের জ্ঞানের পরিধি কতটা হলে এ ধরনের সুপারিশ করতে পারেন? যে কোন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই করা যায়- এটা কিভাবে সম্ভব? বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় লিখিত পরীক্ষা হলো মুখস্থ বিদ্যার বহির্প্রকাশ মাত্র। এক বছর বিসিএস গাইড বই গলাধঃকরণ করে ‘জি, জি স্যার’ মার্কা আমলা হওয়া যায়। অবশ্য একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হলে আমলা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে যে কোন পার্থক্য থাকবে না সে রাজনৈতিক অর্থনীতিটা আমলারা বুঝতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া- যাদের আমরা উচ্চশিক্ষার তীর্থস্থান বলে মনে করি, সেখানে কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা নেয়ার বিধান নেই। অবশ্য, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভোটার নিয়োগের জন্য যেভাবে গণহারে একসঙ্গে ৫-১০ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, সেভাবে এসব দেশে নিয়োগ করা হয় না। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক নিয়োগের নামে মেধাবী বাছাই করে না, তারা প্রয়োজনের নিরিখে শিক্ষক তৈরি করে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন এ বিষয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। তিনি লিখেছেন, ‘অহো কী অদ্ভুত কৌতুক! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হবে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে!’ তিনি বলেছেন, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন তো দরকারই। তবে দেখার কথা ছিল, শিক্ষক আদৌ পড়াতে পারবেন কিনা। সেটা বুঝে নেয়া যায় তাকে পাবলিক লেকচার দিতে দিলে। বিষয়ে তার দখল বোঝা যায়, তার গবেষণা কর্মের খতিয়ান করে। এবার ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-পরীক্ষার তোতা-পাখি গাইড বেরুলো বলে।’
×