ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভের টাকা ফেরত আনতে ১৫ দিনের মধ্যে মামলা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৫ আগস্ট ২০১৬

রিজার্ভের টাকা ফেরত আনতে ১৫ দিনের মধ্যে মামলা

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরি যাওয়া টাকা ফেরত আনতে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মামলা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। চুরির অর্থ ফেরত পেতে আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে ফিলিপিন্সের স্থানীয় আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে আদালতে আবেদন করতে হবে। ফিলিপিন্সের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আদালতে অর্থ ফেরতের আবেদন করবে। এই আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ১৫ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার বা দেড় কোটি ডলারের সামান্য বেশি আগামী সেপ্টেম্বর মাসেই ফেরত পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে ফের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক (এফআরবি), সুইফট কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামীকাল মঙ্গল ও বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত বিদেশী অপরাধীরা যাতে জানতে না পারে, সে কারণেই তদন্তের কোন তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সরানোর চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে চারটি মেসেজের মাধ্যমে ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকে (আরসিবিসি) সরিয়ে নেয়া হয় ৮১ মিলিয়ন ডলার। আর একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। ওই সময় আরসিবিসি ব্যাংকে যাওয়া টাকার একটি বড় অংশ ফিলিপিন্সের জুয়ার টেবিলে চলে যায়। এর মধ্যে এক ক্যাসিনো মালিক দেড় কোটি ডলার ফিলিপিন্স সরকারের হাতে ফেরত দেন। এ ঘটনায় দেশটির সিনেটের ব্লু রিবন কমিটিতে মোট ৭টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদল মোট ৪ বার ম্যানিলায় যান। সূত্রে জানা গেছে, ফিলিপিনো-চাইনিজ ব্যবসায়ী কিম অংয়ের ফেরত দেয়া ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশকে ফেরত দেয়ার জন্য এন্টি মানিলন্ডারিং কাউন্সিল ও আদালতে কিম অংয়ের দেয়া একটি ঔড়রহঃ গড়ঃরড়হ দাখিল করা হয়। এরপর আদালত ১ জুলাই চধৎঃরধষ ঋড়ৎভবরঃঁৎব ঙৎফবৎ জারি করেন। এর ফলে শীঘ্রই ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, ফিলিপিন্সের স্থানীয় আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে এফিডেভিটের মাধ্যমে আদালতে এ অর্থ ফেরত আনতে আবেদন করতে হবে। তিনি বলেন, ফিলিপিন্সের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আদালতে অর্থ ফেরতের আবেদন করবে, যা আগামী ১৬-৩০ আগস্টের মধ্যে করতে হবে। আশা করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ১৫ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার বা দেড় কোটি ডলারের সামান্য বেশি আগামী সেপ্টেম্বর মাসেই ফেরত পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই কথা জানালেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, যে দেড় কোটি ডলার ফিলিপিন্সের বিচার বিভাগের কাছে রয়েছে, আইনী প্রক্রিয়া শেষ হলে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই দেড় কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়ে যাবে। তবে ফিলিপিন্সের ক্যাসিনোতে যে টাকা রয়েছে, তা ফেরত পেতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। কাল যুক্তরাষ্ট্রে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ॥ এদিকে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে ফের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক (এফআরবি), সুইফট কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামীকাল মঙ্গল ও বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে এ বৈঠক হবে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা অংশ নেবেন। তারা হলেনÑ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইনফরমেশন সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) দেবদুলাল রায়, এ্যাকাউন্টস এ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মোঃ জাকের হোসেন ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সি বিভাগের (বিএফআইইউ) যুগ্ম পরিচালক (জেডি) মোহাম্মদ আবদুর রব। রবিবার রাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্রে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও সুইফটেরও দায় আছে। আগের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি তুলে ধরে অর্থ উদ্ধারে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এবারের বৈঠকেও বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। বিশেষ করে আগের বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন কোন পর্যায় আছে তা আলোচনা করা হবে। এর আগে গত ১০ মে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল শহরে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির, নিউইয়র্ক ফেডের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ডাডলি ও সুইফট কর্তৃপক্ষ উপস্থিত ছিলেন। ঐ বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয় এফআরবি নিউইয়র্কের ওয়েবসাইটে। তাতে বলা হয়, চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে একযোগে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, এফআরবি নিউইয়র্ক ও সুইফট। এছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার এবং অন্যান্য কাঠামোগত নিরাপত্তা ত্রুটি নিয়ে আলোচনা হয়। পরস্পরের মধ্যে তথ্যবিনিময়, চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধার এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে এই তিনপক্ষ একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়। তদন্তের স্বার্থেই প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে না ॥ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত বিদেশী অপরাধীরা যাতে জানতে না পারে, সে কারণেই তদন্তের কোন তথ্য প্রকাশ করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি শনিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা বলেন। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব কর্মকর্তারা হয়ত জড়িত বলেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে না এমন অভিযোগ করেন ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি)। এর জবাবে এ কথা বলেন আজমালুল হোসেন। তিনি বলেন, এ ঘটনার সব তদন্ত সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক খুব ভালভাবেই অবগত। বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছে করেই তদন্তের তথ্য গোপন রেখেছে, যাতে বিদেশী অপরাধীরা এ বিষয়ে জেনে সতর্ক হতে না পারে। এ বিষয়ে জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আরসিবিসি ব্যাংকের লিগ্যাল এ্যান্ড রেগুলেটরি এ্যাফেয়ার্স প্রধান মারিয়া সেলিয়া এসতাভিল্লো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত বলেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না। পুরো তদন্ত শেষ করতে হবে। বাংলাদেশে কী হয়েছিল ও কারা জড়িত, তা বের হওয়া উচিত। প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি ফিলিপিন্স সরকারের পাওয়া উচিত। আরসিবিসির আইনি পরামর্শক থিয়া টি দায়েপ সম্প্রতি এক বিবৃৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘নিকৃষ্ট’ ও ‘সস্তা’ সার্ভার সিস্টেম ব্যবহার করেছে। সেখানে কোন প্রতিরোধক বা ফায়ারওয়াল ছিল না। এ কারণে হ্যাকাররা সহজে সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙ্গে অর্থ সরিয়ে নিতে পেরেছে। থিয়ার দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কী এমন ঘটেছিল যে তারা নিজেরাই তা জানতে চায় না। তবে যা ঘটেছিল, তা অবশ্যই জনগণকে জানানো উচিত। তারা শুধু বলছে, এ ঘটনায় তারা ভুক্তভোগী এবং অর্থ ফেরত পেতে চাইছে। অথচ ঘটনার শুরুটা হয়েছিল তাদের অবহেলার কারণে। এ ঘটনার দায়ে ৫ আগস্ট আরসিবিসিকে ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০০ কোটি পেসো বা ২ কোটি ১০ লাখ ডলার জরিমানা করে। দুই কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য এ জরিমানার অর্ধেক গত শনিবার পরিশোধ করেছে আরসিবিসি।
×