ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অলিম্পিকের পর্দা উঠছে বর্ণাঢ্য আয়োজনে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ আগস্ট ২০১৬

অলিম্পিকের পর্দা উঠছে বর্ণাঢ্য আয়োজনে

সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ব আর বিশ্বশান্তি কামনা করে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনীর মধ্যে দিয়ে শুরু হচ্ছে অলিম্পিক গেমস। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ -অলিম্পিক গেমসের ৩১তম আসরের পর্দা ওঠার অপেক্ষা। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ৮টায় শুরু হবে জমকালো, বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সময়ের পার্থক্যের কারণে যা বাংলাদেশ সময়ে শুরু হবে শনিবার ভোর ৫টায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন পরের দিন। ব্রাজিলের সঙ্গে সময় পার্থক্যই এর কারণ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আকর্ষণীয় করতে আয়োজকরা সহযোগিতা নিয়েছে চীন, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। এই তিনটি দেশে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের অতীত আসরগুলোর উদ্বোধনী ও সমাপনী এখনও হৃদয়ে দাগ কেটে রেখেছে বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের। তাছাড়া সাংগঠনিক দক্ষতা ব্রাজিলিয়ানদেরও কম নয়। মাত্র বছর দেড়েক আগে সফলভাবে আয়োজন করেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের। রিওর মারাকনা স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফুটবলের বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও খেলা। আর অলিম্পিক গেমসের জন্যও বেছে নেয়া হয়েছে এই ভেন্যু। রাতের মারাকানা আলোর মালায় এমনিতেই নজর কাড়ছে সবার। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অবশ্য ফুটবলের চেয়ে বেশি সময়ের। স্থানীয় সময় রাত ৮টায় শুরু হওয়া চার ঘণ্টাব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন শিল্পী। আকর্ষণীয় লেজার শো’র পাশাপাশি রয়েছে নানা রঙের, বর্ণের আতশবাজির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। যা রাতের আকাশ বর্ণময় করে তুলবে। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা আছে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ ও ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) প্রেসিডেন্ট টমাস বাখের। এ দু’জনের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে পারেন রিও গেমসের। তবে বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উদ্বোধন কে করবেন সেটা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগতিক ব্রাজিল দেশীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী সাম্বা নৃত্য তো থাকছেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ?শুরুতেই থাকবে পতাকা নিয়ে এ্যাথলেটদের মার্চপাস্ট। এরপর পর্যায়ক্রমে নানা শো। সবশেষে থাকবে বর্ণিল আতশবাজি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন সিটি অব গড বিখ্যাত চলচ্চিত্রের পরিচালক ফার্নান্ডো মেয়ারলেস। তার সঙ্গে থাকবেন আন্ড্রুচা ওয়াশিংটন ও ড্যানিয়েলা থমাস। মজার ইভেন্টে গান করবেন সাম্বা সিঙ্গার এলজা সোয়ারেস। তিনি ব্রাজিলের সাবেক কিংবদন্তি ফুটবলার গ্যারিঞ্চার স্ত্রী। তার সঙ্গে থাকবে ১২ বছর বয়সী এমসি সোফিয়া। আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনী আয়োজনে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশনাই অধিক গুরুত্ব পাবে। সহস্রাধিক এ্যাথলেট জাতীয় পতাকা হাতে প্যারেড করবেন। লাইট এ্যান্ড সাউন্ড শো এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে ব্রাজিলে পর্তুগীজ উপনিবেশের ইতিহাস। উদ্বোধনী মঞ্চ আলো করবেন ব্রাজিলের সুন্দরী এবং সুপার মডেলরা। কিংবদন্তি ব্রাজিলিয়ান মডেল গিজেল বান্ডচেন ক্যাটওয়াকের মাধ্যমে মঞ্চ আলোকিত করবেন। ক্যাটওয়াকের বড় একটি অংশজুড়ে থাকবেন মেইনস্ট্রিম ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সব ধারণা বদলে দেয়া ট্রান্সজেন্ডার মডেল লি টি। অলিম্পিকের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোন ট্রান্সজেন্ডার মডেল মঞ্চ মাতাবেন। ২০৬ দেশ, ১১ হাজার ২শ, ৩২ ক্রীড়াবিদ, ৩৩৬ স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক জন্য লড়াই করবেন। গেমস শুরুর দুই দিন আগেই অবশ্য শুরু হয়ে গেছে ফুটবল। আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন দুপুরে তীরন্দাজদের লড়াই আরচারি। এদিন থাকছে বাংলাদেশও। উইমেন্স ইনডিভিজ্যুয়াল র‌্যাঙ্কিং রাউন্ডে ভাগ্য পরীক্ষা শ্যামলী রায়ের। এরপর পর্যায়ক্রমে জাতির জন্য লড়বেন, শূটার আবদুল্লাহ হেল বাকী, অনেক আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা গলফার সিদ্দিকুর রহমান, ভাল ফল প্রত্যাশা করা সাঁতরু মাহফিজুর রহমান সাগর, সোনিয়া আক্তার, দুই স্প্রিন্টার মেসবাহ আহমেদ ও শিরিন আক্তার। ব্রাজিলের ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মার্চপাস্টে সাত ক্রীড়াবিদের সঙ্গে থাকবে ১৬ সদস্যের বাংলাদেশ দল। মার্চপাস্টের অগ্রভাগে জাতীয় পতকা বহন করতে দেখা যাবে সিদ্দিকুর রহমানকে। সরাসরি সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাকেই সম্মান দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা বহনের। এদিকে গেমস শুরুর আগেরদিন থেকেই নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন ব্রাজিলের মানুষ। দক্ষিণ আমেরিকায় এবারই প্রথম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে অলিম্পিক গেমস। অথচ রিও আসার পর এতদিন উত্তাপ পাওয়া যায়নি অলিম্পিকের। খেলাধুলার প্রাণ হচ্ছে দর্শক। আর তাদের যদি আগ্রহ না থাকে তখন খেলা আর খেলা থাকে না। গত কয়েকদিনের চিত্র দেখে মনে হচ্ছিল অলিম্পিক নিয়ে এদেশের মানুষের কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পল্টে গেছে গোটা চিত্র। স্বাগতিক দেশের মানুষের আগ্রহ না থাকলে ‘ম্যারম্যারে অলিম্পিক’ হিসেবে একটা কলঙ্কের দাগ ওঠে যেত ব্রাজিলের ললাটে। কিন্তু না, কর্মব্যস্ত মানুষ জেগে উঠেছে। বিশেষ করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে রিও এখন উৎসবের শহর। রাস্তায় চলমান সারি সারি গাড়িতে শোভা পাচ্ছে ব্রাজিলের পতাকা। মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় হৈহুল্লোর করে, জোরে হর্ন বাজিয়ে চিৎকার করে যুবকরা মাতিয়ে তুলেছেন রিও শহর। বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনাও লক্ষ্যণীয়, জিকা আতঙ্ক, আইএস হামলার শঙ্কায় অনেকে দেরিতে এসেছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর পা রাখছেন রিওতে। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকদের ভিড় গেমসের জন্য বিরাট অলঙ্কার। গেমস ঘিরে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা গোটা রিও ডি জেনিরো। ভারি অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর টহল, মোড়ে মোড়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে, যুদ্ধসাজে নিরাপত্তারক্ষী। এসব প্রস্তুতি বা আয়োজন প্রমাণ করছে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। আর জিকা ভাইরাস? এটার কোন অস্তিত্ব টের পেলাম না গত চারদিনে। অলিম্পিকের ইতিহাস নিয়ে কিছু না বললেই নয়। সে অনেক আগের কথা। প্রাগৈতিহাসিক যুগ পেরিয়ে আর্য সভ্যতা বিস্তৃত হওয়া পর্যন্ত মানুষের বিনোদন বা খেলাধুলা বলতে কিছইু ছিল না। তীর-ধনুক দিয়ে জীব, জন্তুর সঙ্গে লড়াই করত মানুষ। আর্য যুগকে পূর্ণতা দেয় গ্রীক সভ্যতা। এক পর্যায়ে গ্রীকরাই মানুষের মধ্যে একটা উৎসব ছড়িয়ে দিতে আয়োজন করত নানা ধরনের মেলা। সেখানেই অন্তর্ভুক্ত থাকত খেলা। নাচ-গানের পাশাপশি মুষ্ঠিযুদ্ধ, পাথর ছোড়া, বর্শা নিক্ষেপ, কুস্তিসহ আরও কিছু প্রতিযোগিতা। এসব খেলা নিয়েই গ্রীসে এক সময় আয়োজন করা হয় ‘হেলেনিক ন্যাশনাল’ নামক গেমস। যা পরবর্তীতে অলিম্পিয়াড ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হিসেবে স্থান করে নেয়। অলিম্পিয়া হচ্ছে গ্রীসের একটি নগরীর নাম। ১৮৫৮ সালে গ্রীস প্রথমবারের মতো অলিম্পিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। উপযুক্ত মাঠ না থাকায় গেমসের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় এথেন্সের রাস্তায়। এরপর ১৮৭০ সালে ফের বেসরকারী অলিম্পিক গেমস আয়োজন করে এথেন্সে। এভাবে কয়েকটি আয়োজনের পর ফ্রান্সের ব্যরন পিয়েরে ডি কুবার্তিন অলিম্পিক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। হাল ধরেন অলিম্পিকের। বিশ্ব ভ্রতৃত্বের বন্ধন জোরালো করতে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা পায় আধুনিক অলিম্পিক। সে বছর গঠিত হয় প্রথম অলিম্পিক কমিটি। কুবার্তিন ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে অলিম্পিককে কিভাবে আধুনিক রূপ দেয়া যায় তার খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। তা পরবর্তীতে গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু আধুনিক অলিম্পিক গেমসের, যার জনক হয়ে ওঠেন কুবার্তিন। বিশ্বশান্তি, বন্ধুত্ব জোরালো করতে প্রাচীন অলিম্পিকের আদলে ১৯৮৯ সালে আনুষ্ঠানিক অলিম্পিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নেন কুবার্তিন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাওয়া অলিম্পিক বর্তমানে বিশ্ব ক্রীড়ার সেরা আসরে জায়গা দখল করে নিয়েছে।
×