ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সব স্কুলের মালিক শিবির নেতা হলেও কোথাও কোথাও স্কুল কমিটিতে আওয়ামী লীগারদেরও রাখা হয়

দেশের সব পিস স্কুল বন্ধ ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩ আগস্ট ২০১৬

দেশের সব পিস স্কুল বন্ধ ঘোষণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জামায়াত-শিবিরের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক আদর্শে পিস স্কুল চলছে- গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ও গণমাধ্যমে এমন তথ্য বেরিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে অবশেষে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয় আদেশ জারি করে বলেছে, অনুমোদনহীন সকল পিস স্কুল অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকার লালমাটিয়ায় পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঠদানের অনুমতি বাতিল করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকেও নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, বিতর্কিত কার্যক্রমে লিপ্ত থাকায় অনুমোদন পাওয়া লালমাটিয়ার পিস স্কুলটির পাঠদানের অনুমতি বাতিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী কয়েক আমলার কারণে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশ সত্যেও উগ্রবাদী এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধের প্রক্রিয়া আটকে ছিল কয়েক মাস। তারা এগুলো চালু রাখতে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সুনির্দিষ্ট তদন্ত রিপোর্টের পরও ব্যবস্থা না নিয়ে রহস্যজনকভাবে নতুন করে আবার তদন্ত শুরু করেছিল। লক্ষ্য ছিল তদন্তের কথা বলে সময়ক্ষেপণ। কয়েক কর্মকর্তার এ কর্মকাণ্ড নিয়ে সম্প্রতি জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এছাড়া পিস স্কুলের বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে সোমবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী কর্মকর্তাদের ডেকে কোন টালবাহানা না করে বিকর্তিক ও অনুমোদনহীন সব পিস স্কুল বন্ধের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত লালমাটিয়ায় পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঠদানের অনুমতিও বাতিল করতে নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী। ভারতের বিতর্কিত ইসলামী বক্তা জাকির নায়েকের পিস টিভির সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধের পর মঙ্গলবার পিস স্কুলগুলোও বন্ধের নির্দেশ এলো। গুলশান হামলাকারী অন্তত দুজন জঙ্গী জাকির নায়েকের বক্তব্যে প্ররোচিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠার পর পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধে গত ১১ জুলাই সরকারের সিদ্ধান্ত আসে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এ টি এম মইনুল হোসেন-এর আগে জানিয়েছিলেন, ঢাকার লালমাটিয়ায় পিস স্কুল নামে একটি ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের সাময়িক নিবন্ধন দিয়েছেন তারা। পিস স্কুল নামে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কোন অনুমোদন নেই। ২০১১ সাল থেকে লালমাটিয়ার বিব্লকের হাউজ ৪/৯ এর ‘পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের’ জুনিয়র সেকশন এবং লালমাটিয়ার বিব্লকের হাউজ ৫/৭ এ এই স্কুলের সিনিয়র সেকশনে ইংরেজী মাধ্যমে প্লে-গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে সম্প্রতি জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের উগ্রবাদী শিক্ষা দেয়ার তথ্য প্রমাল বেরিয়ে আসার পর তোলপাড় শুরু হয়। একে একে অভিযোগ আসতে থাকে অন্য প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেশে অন্তত ২৭টি পিস স্কুলে জামায়াত-শিবিরের কর্মকা- চলার প্রমাণ মিলেছে আগেই। জঙ্গীবাদী প্রচারণার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতে পিস টিভি বন্ধের পর পিস স্কুল বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছিল। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ‘পিস’ নামের তিনটি স্কুলকে শোকজও করেছিল ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। বোর্ডের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে শোকজের চিঠি পাঠানো হয়। কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ঢাকায় এ ধরনের কতটি প্রতিষ্ঠান আছে তা সঠিভভাবে জানা নেই। তবে শুনেছি ধানম-ি, মিরপুর ও উত্তরায় অনুমোদনহীন তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর মধ্যে উত্তরাটি বেশি ভয়ংকর। সেটির থিম সংয়ে আপত্তিকর কথামালা আছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোপোর্টেই ঢাকাসহ দেশের ১৫টি জেলায় ‘পিস’ নাম যুক্ত করে ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের প্রায় সবাই জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মী। জনগণের চোখে ধুলা দিতে কোথাও আওয়ামী লীগের নেতা আবার কোথাও বিএনপি নেতাদের সভাপতিসহ পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকার সমর্থক ব্যক্তিদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশও করা হয়েছিল রিপোর্টে। দেশের ছয়টি জেলায় পরিচালিত পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ জামায়াতের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। ‘পীস’ শব্দটি ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের শতাধিক স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে জামায়াতের দলীয় আদর্শের পাঠ্যবই পড়ানো হয়। এসব স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। আবার কোনও কোনও স্কুল পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও রয়েছেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে পরিচালিত স্কুলগুলোকে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক কাজে ব্যবহার করছে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। পিস স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জামায়াত-শিবিরের নেতা ও জড়িত সরকারী কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে এতে। এছাড়া স্কুলের আয়ের উৎস ও ব্যয় খতিয়ে দেখতেও বলা হয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলার কথাও আছে প্রতিবেদনে। এছাড়া প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এসব প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার জন্য দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়ার সুপারিশও আছে। প্রতিবেদনে পিস স্কুলের শিক্ষার্থীরা উগ্র ধর্মীয় মতবাদে দীক্ষিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন কোন পিস স্কুল পরিচালিত হয় ‘ইনভাইটস পীস লিমিটেড’ নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর জামায়াতের রোকন আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর জামায়াতের রোকন আলমগীর মোঃ ইউনুস। পিস স্কুলে কেন্দ্রীয় জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ড. আহসান হাবীব ইমরোজ সম্পাদিত বাংলা বই, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী ও মতিউর রহমান নিজামীর লেখা সাংগঠনিক বই পড়ানো হয়। এদিকে ঢাকার মালিবাগ, উত্তরা ও মিরপুরের তিনটি পিস স্কুলের যোগাযোগের নম্বরে যোগাযোগ করলেও কেউই ফোন ধরেননি। এসব স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য স্কুলগুলোর ওয়েবসাইটে দেয়া মোবাইল নম্বরগুলোও বন্ধ পাওয়া যায়। ঢাকার ৪০০/বি, মালিবাগ চৌধুরীপড়ায় ‘পিস স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় চলছে। পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজ নামে উত্তরা ও মিরপুরে দুটি স্কুলের খোঁজ পাওয়া গেছে। উত্তরা ক্যাম্পাসের ঠিকনায় লেখা আছে- হাউস ৫৯, রোড ৫, সেক্টর ১৩, উত্তরা মডেল টাউন। আর মিরপুর ক্যাম্পাসের ঠিকানা- প্লট ৫, রোড ২৮/ক, রূপনগর আবাসিক এলাকা। এরই মধ্যে উত্তরা ও রাজশাহীসহ কয়েকটি শহরে তারা পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে নিয়েছে। পিস স্কুলের পরিবর্তে তারা কোথাও লিজেন্ড একাডেমি নাম দিচ্ছে আবার কোথাও কোন নামই রাখছে না। প্রচার করা হয়, পিস স্কুল দেশের প্রথম ত্রিভাষিক চেইন স্কুল। এই প্রতিষ্ঠানে আরবি, ইংরেজী ও বাংলার সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। তবে জানা গেল, রাজধানীতে পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজ পরিচালিত হচ্ছে ইনভাইট পিস লিমিটেড নামক একটি কোম্পানির মাধ্যমে। এর চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। তিনি ছাত্রশিবিরের ১১তম সভাপতি ছিলেন। যিনি ১৯৯১-৯২ সেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাকে বিভিন্ন সময় ছাত্রশিবিরের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। ছাত্রশিবিরের মুখপত্র ছাত্র সংবাদেও নিয়মিত লিখেন ওবায়েদুল্লাহ। এই ইনভাইট পিস লিমিটেড সারাদেশে অনেক শাখা স্কুল পরিচালনা করছে। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, দিনাজপুর ও খুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে।
×