ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে বিজিএমইএ ভবন ভেঙ্গে ফেলতেই হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩ জুন ২০১৬

অবশেষে বিজিএমইএ ভবন ভেঙ্গে ফেলতেই হচ্ছে

বিকাশ দত্ত ॥ জলাধার রক্ষা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গড়ে ওঠা বিজিএমইএ (পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি) ১৮ তলাবিশিষ্ট ভবন ভাঙ্গার হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। এ চূড়ান্ত রায়ের ফলে রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি করে বেআইনীভাবে প্রায় দুই দশক আগে গড়ে ওঠা বিজিএমইএ ভবন ভেঙ্গে ফেলতেই হবে। ভবনটি অবৈধ ঘোষণা করে তা ভেঙ্গে ফেলতে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএর আপীল আবেদন বৃহস্পতিবার খারিজ করে আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় প্রদান করেন। আপীল বিভাগ রায় ঘোষণায় হাতিরঝিলের ভবনটি বিষফোঁড়া বলে উল্লেখ করেছে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, হাতিরঝিলের লেককে কেন্দ্র করে সৌন্দর্যবর্ধনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ ভবনের কারণে সে সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এটি একটি বিষফোঁড়া। সরকারী একটি সংস্থার জমি আরেকটি সংস্থা কিভাবে বিজিএমইকে বরাদ্দ দেয়? জলাধার আইন অনুযায়ীও লেক দখল করে ভবন গড়ে তোলা অবৈধ। হাইকোর্টে এ মামলার এ্যামিকাস কিউরি এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জানান, হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় ৯০ দিনের মধ্যে বিজিএমইএ ভবন ভাঙতেই হবে। অন্যদিকে বিজিএমইএর আইনজীবী রফিক-উল হকও বলছেন, ভবনটি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্ট বলেছিল বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙ্গে দিতে। আপীল বিভাগ এটি কনফার্ম করেছে। তার মানে বিল্ডিংটা ভেঙ্গে দিতে হবে।’ এ্যাডভোকেট সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের এ রায়ের ফলে ভূমিদস্যুদের হাত থেকে জলাশয় রক্ষার আন্দোলন আরও বেগবান হবে। সমাজের দায়মুক্তি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ রায় একটা মাইলফলক। আদালতে বিজিএমইএর পক্ষে ছিলেনÑ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, তার সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আইনজীবী মনজিল মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গড়ে ওঠা বিজিএমইএ (পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি) ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ দেয়। সে সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আদালতে বলেছিলেন, ‘বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যম-িত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রমিত করবে।’ রিভিউর বিষয়ে বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত ॥ বিজিএমইএর আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাতের ব্যবসায়ীদের সমিতির এ ভবনটি ভাঙলে তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা ভেঙ্গে দিলে অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টস শিল্পের ওপর। আপীল বিভাগের এ রায় পুনঃবিবেচনার আবেদন করা হবে কি-না, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বিজিএমইএর এক আইনজীবী জানান। তিনি বলেন, রিভিউ করবে কি করবে না, সে বিষয়ে বিজিএমইএর বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হবে। আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের আলোকে রিভিউর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। হাইকোর্টের রায় ॥ ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্ট রায়ে বেশকিছু নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছেÑ এ জমির মালিকানা স্বত্ব বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষের নেই, সে কারণে তাদের ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। ভবনটি তৈরি করার কারণে বেগুনবাড়ি খালের পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং হাতিরঝিল প্রকল্পে বিঘœ ঘটাচ্ছে। তাই ভবনটি ভিত থেকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। বেগুনবাড়ি খাল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনে হাতিরঝিল প্রকল্পকে মূল নক্সা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে বলেছে আদালত। বিজিএমইএ ভবনের কিছু অংশ ইজারা এবং বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালত বলে, যারা এ ভবনে বিক্রি এবং ইজারার মাধ্যমে দখল পেয়েছেন তাদের বিনিয়োগের অগেই চিন্তা করা উচিত ছিল। তবে তারা চাইলে চুক্তি আইন ও জালিয়াতির অভিযোগে প্রতিকার চাইতে পারেন বলে আদালত জানিয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, এ ভবনের মাধ্যমে ফৌজদারি যে অপরাধ হয়েছে তা তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার এবং ঢাকার ডিসিকে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে হাইকোর্ট। জলাধার রক্ষা আইন লঙ্ঘনের জন্য পরিবেশ অধিদফতরকে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলেছে আদালত। ভবনটি ভাঙ্গার সময় শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সে কাজ করতে বলেছে আদালত, যাতে কোন প্রাণহানি না ঘটে। দশ এ্যামিকাস কিউরি ॥ মামলাটি শুনানির জন্য এলে হাইকোর্ট ১০ আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ দেন। এরা হলেনÑ ড. এমএ জহির (বর্তমানে মৃত), সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আকতার ইমাম, এএফএম মেজবাহ উদ্দিন, এ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী, এ্যাডভোকেট আনিসুল হক (বর্তমানে আইনমন্ত্রী), ব্যারিস্টার সারা হোসেন, এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ, ইকবাল কবির লিটন (বর্তমানে বিচারপতি) এবং এ্যাডভোকেট সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান। শুনানিতে এ্যামিকাস কিউরিগণ বলেন, খাল ভরাট করে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের কারণে বেগুনবাড়ি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া আইনসম্মত ছিল না। কেননা, জলাশয় আইন-২০০০-এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী এ ধরনের ভবন নির্মাণ অবৈধ। তাছাড়া ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধও। এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ ভবন নির্মাণে এখতিয়ারবহির্ভূত অনুমোদন দেয় বলে আদালতে দাবি করেন তারা। সিএস খতিয়ান অনুযায়ী নক্সা অনুমোদনের আবেদনে উল্লিখিত দাগের জমিতে নালা ও পুকুর ছিল উল্লেখ করে একজন এ্যামিকাস কিউরি বলেন, এমন জমিতে ভবন নির্মাণের অনুমতি রাজউক দিতে পারে না। বরং এক্ষেত্রে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ ভবনের ক্ষেত্রে সে রকম কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি। অপরদিকে রাজউক হলফনামা দিয়ে আদালতে বলেছে, প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা অনুমোদন ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ শুরু হয়। আরেকবার উদ্যোগ নেয়া হয় ॥ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একবার ভবনটি ভাঙ্গার উদ্যোগ নেয়া হয়। তৎকালীন এলজিআরডি উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেগুনবাড়ি খাল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে ভবনটি ভাঙ্গার বিষয়ে নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ রাজউক বিজিএমইএ ভবনের সামনের টিনশেডের অংশ ভেঙ্গে ফেলে। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবন নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের অক্টোবরে ভবনটির উদ্বোধন করেন। ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল বেআইনী ॥ বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। হাইকোর্ট বলেছে, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিল বেআইনী। কারণ, ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোন অংশ কারও কাছে বিক্রির কোন অধিকার বিজিএমইএর ছিল না। ‘তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিত ছিল যে, এ জমির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তারা কোন ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়।’ দেশের প্রধান রফতানি পণ্যের শিল্পোদ্যোক্তাদের সমিতির এ ভবনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘আর্থিক পেশীশক্তির অধিকারী বলে’ শক্তিশালী একটি মহলকে ‘আইনের উর্ধে রাখতে হবে’ এমন যুক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ‘একটি গুরুত্ব¡পূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।’ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ি খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে পাঁচ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নবেম্বর ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রফতানি উনয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনীভাবে প্রদান করে। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না। ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নক্সা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও ভবনটি ভাঙ্গার দাবি জানিয়ে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণী বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে এবং এতে এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
×