ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে খুন, একটার রেশ না কাটতেই ঘটছে আরেকটি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৯ মে ২০১৬

হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে খুন, একটার রেশ না কাটতেই ঘটছে আরেকটি

শংকর কুমার দে ॥ বখাটে মাদকাসক্ত যুবকের উত্যক্তের বলি কনিকা রানী ঘোষ। তার বয়স প্রায় ১৬। দশম শ্রেণীর ছাত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিপুর এস এ এম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ফুল ফোটার আগেই বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে ফেলার মতো বখাটে যুবকের ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি আঘাতে বিদায় করে দেয়া হলো তাকে। সেদিন কনিকার সঙ্গে আহত হয় তার সহপাঠী তানজিলা খাতুন, মরিয়ম খাতুন ও তারিন। বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী বখাটে মাদকাসক্ত মালেককে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে। শুক্রবার সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোবরাতলা ইউনিয়নের মহিপুর গ্রামের এই নির্মম নৃশংস খুনের ঘটনায় দেশব্যাপী চলছে তোলাপাড়। হঠাৎ করেই দেশব্যাপী বেড়ে যাচ্ছে খুন। একই সঙ্গে ঘটছে ১৫ ধরনের অপরাধ। পরিকল্পিতভাবে অবনতি ঘটানো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১১ জন খুন হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে সারাদেশে খুন হয়েছে ১ হাজার ১শ’ ৫৬ জন। ২০১৫ সালে দেশে খুন হয়েছে ৪০৩৫জন। ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে দেশে খুন হয়েছে ২৫ হাজার ৪৭জন। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশব্যাপী এই খুনের ঘটনার চিত্র পাওয়া গেছে। বেসারকারীভাবে খুন ও নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা অনেক বেশি বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ। খোদ রাজধানী ঢাকায় পরকীয়ার বলি হয়েছেন সায়েম গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মনিরুল ইসলাম। মা ও মেয়ের সঙ্গে ছিল তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। এই অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলে পুত্র মুরসালিন। তার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। মা ও বোনের সঙ্গে মনিরুল ইসলামের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক জেনে ফেলার পর মনিরুল ইসলামকে খুন করার পরিকল্পনা করে মুরসালিন। মুরসালিন তার বন্ধু শাকিল, আকাশ, আশিক এবং জুয়েলকে নিয়ে খুন করে তাকে। গত ১৭ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর নন্দীপাড়া ব্রিজের পাশে খুন করার পর খিলগাঁওয়ে রাস্তার পাশে থেকে উদ্ধার করা হয় মনিরুলের নিথর দেহ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মুরসালিন ও তার বন্ধুদের গ্রেফতারের পর মা ও বোনের সঙ্গে পরকীয়ার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে মনিরুলকে খুন করার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে সামাজিক অবক্ষয় ঘটানোর অপচেষ্টার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত কনিকা রানী ঘোষ ও মনিরুল ইসলাম খুনের ঘটনা। এ ধরনের খুন ছাড়াও পরিকল্পিতভাবে খুন করানো হচ্ছে প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, প্রকাশক ও শিক্ষক, ধর্মযাজকসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে। উত্থান ঘটানো হচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠীর। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিরুদ্ধে দেশের মধ্যে সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের বাইরের সীমানায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের ছক। বর্তমান সরকার উৎখাতের জন্য ঘটানো হচ্ছে খুন ছাড়াও নানা ধরনের অপরাধের নীলনকশা। অভিযোগ করা হয়েছে, এই ধরনের খুনসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকা-ের নেপথ্যের কারসাজি রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের। অদৃশ্য মহল থেকে কলকাঠি নাড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। দেশব্যাপী নাশকতা, নৈরাজ্য, অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগের তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা। দেশে খুনসহ যে ১৫ ধরনের অপরাধ সঙ্ঘটিত করানো হচ্ছে তার মধ্যে ডাকাতি, দস্যুতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশ এ্যাসল্ট, চুরি, হুমকি, বেআইনী অস্ত্রের ব্যবহার, বিস্ফোরক, মাদক, চোরাচালান ও অন্যান্য। দেশে খুনসহ কি ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে তার এই পরিসংখ্যান পুলিশ সদর দফতরের। জমিজমা, অর্থের লেনদেন, পূর্ব শত্রুতা, পরকীয়া, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও এখন খুনের মতো ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ সালে সারাদেশে খুন সঙ্ঘটিত হয়েছে ৩৯৮৮টি। ২০১১ সালে খুন সঙ্ঘটিত হয়েছে ৩৯৬৬টি। ২০১২ সালে খুন সঙ্ঘটিত হয়েছে ৪১৪৯টি। ২০১৩ সালের খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪৩৯৩টি। ২০১৪ সালে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪৫১৫টি। ২০১৫ সালে খুনের ঘটনা ৪০৩৫টি। গত ৫ বছরের খুনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান হলেও গত ২০১৫ সালে খুনের ঘটনা কম দেখানো হয়েছে পুলিশের পরিসংখ্যানে। তবে ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিবাদে নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে তাদের হাতে খুনের ঘটনা ঘটানোর কারণে খুন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সম্পর্কে পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, যুদ্ধাপরাধীর সমর্থক ও জঙ্গী গোষ্ঠী। দেশে ব্যাপক নাশকতা ও নৈরাজ্য চালিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এই মহলটি। গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সরকার ও সরকারী দল আওয়ামী লীগ যখন দেশকে স্থিতিশীল করার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে দৃষ্টি দিচ্ছে তখনই আবার নতুন করে একের পর খুন করানো হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে একটি চক্র টার্গেট কিলিংয়ে নেমেছে। ২০১৫ সাল থেকে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। বিদেশী নাগরিকসহ টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটিয়েই আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিআইএস) ছাড়াও দেশী জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামকে দায় স্বীকার করে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিবৃতি দেয়ানো হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিদেশী এসব জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব বরাবরই অস্বীকার করে আসার পরও বিবৃতি দেয়ানো অব্যাহত আছে। রাজধানীর কলাবাগানে বাংলাদেশর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এর আগে ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, একই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পরমানন্দ রায় নামে এক সাধুকে প্রায় একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করার পর আন্তজার্তিক জঙ্গী সংগঠনের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, সম্প্রতি যেসব হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে সেগুলো দা দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে ঘটিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করানোর কায়দা অবলম্বন করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩৩তম নিরাপদ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক বলেছেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভাল রয়েছে। চুরি, ডাকাতি, হত্যাসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে পুলিশি তৎপরতার কারণে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মওনালা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশিং সায়েন্স বিভাগের এক সেমিনারে অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেছেন আইজিপি। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে খুনোখুনী। একটির রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরেকটি খুনের ঘটনা। ঘটছে টার্গেট কিলিং। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেয়া নানা পদক্ষেপের পরও নির্বিঘেœ খুন করে পালিয়েও যাচ্ছে ঘাতকরা। খুনের শিকার হচ্ছেন ব্লগার, ব্যবসায়ী, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণী- পেশার মানুষ। নৃশংস এসব খুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মনে যেমন আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এসব খুনের কোন কোন ঘটনায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্নমতাবলম্বীরাও টার্গেট হচ্ছেন ঘাতকদের। দু-একটি ঘটনায় খুনীদের কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও অধরাই থাকছে নেপথ্যে থাকা মদদদাতা ও গডফাদার। এই ধরনের ঘটনা বৃদ্ধিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শিথিলতাকেই দায়ী করে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, পুলিশের রাজনীতিকীকরণ, তোষামদ, তদ্বির, চেন অব কমান্ডের দুর্বলতা, মাঠপর্যায়ে পুলিশী তৎপরতায় ভাটা পড়ার কারণেই খুনোখুনীর ঘটনা বেড়েছে। এটা এক অশুভ ও অসুস্থ লক্ষণ বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকগণ।
×